উদ্যোগ
'মায়ের ব্যাংকে' আশার আলো

চট্টগ্রামে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সরবরাহকৃত 'মায়ের ব্যাংক'- সমকাল
শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:২৫
ফরিদা বেগম। প্রথম সন্তান গর্ভে আসার আট মাসের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হারান রিকশাচালক স্বামী ইমদাদ হোসেন। তবে সন্তান গর্ভে আসার দিন থেকে সংসারের প্রতিদিনের খরচ থেকে বাঁচিয়ে কোনোদিন ২০, কোনোদিন ৫০; কোনোদিন ১০০ টাকাও সঞ্চয় করে ব্যাংকে জমিয়েছেন তিনি। এভাবে আট মাসে তার সঞ্চয় হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার টাকা। ফরিদা বেগমের মতো স্বামীর দৈনন্দিন আয়ের একটি অংশ থেকে নয় মাসে ১৭ হাজার ৯০০ টাকা সঞ্চয় করেছেন গৃহিণী লীনা বেগম। সন্তান গর্ভে আসার পর ডেলিভারির আগে-পরের খরচ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় ছিলেন তারা। তবে জমানো টাকা সেই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছে তাদের।
এমন অবস্থা কেবল ফরিদা ও লীনার নয়। এ দুই প্রসূতির মতো অনেকেই প্রতিদিনের সংসার খরচ থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে 'মায়ের ব্যাংকে' জমিয়ে দেখছেন আশার আলো। কথাশিল্পী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'বিন্দু থেকে সিন্ধু'র মতোই প্রতিদিনের সামান্য জমানো টাকা এক সময় হচ্ছে বড় বিপদের বন্ধু।
চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো অন্তঃসত্ত্বা পাঁচ হাজার নারীকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে 'মায়ের ব্যাংক'। ব্যাংকে সঞ্চয়কৃত টাকা যাতে মা ও নবজাতকের উপকারে আসে সে লক্ষ্যেই এমন উদ্যোগ। জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলাসহ মহানগরীর দুটি থানার পরিবার পরিকল্পনা অফিসে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মাঝে বিতরণের উদ্দেশ্যে পাঁচ হাজার মায়ের ব্যাংক সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে মিরসরাইয়ে ৪১০টি, সীতাকুণ্ডে ৩৬০টি, সন্দ্বীপে ২৮৫টি, হাটহাজারীতে ৩৫৫টি, ফটিকছড়িতে ৫১০টি, রাউজানে ৩০৬টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৩৫৫টি, বোয়ালখালীতে ২২৫টি, পটিয়ায় ৪৭৫টি, চন্দনাইশে ২১৫টি, সাতকানিয়ায় ৩৩০টি, লোহাগাড়ায় ২৪১টি, বাঁশখালীতে ৩৮০টি, আনোয়ারায় ২৩০টি, ডবলমুরিংয়ে ২১৬টি এবং পাঁচলাইশ থানা পরিবার পরিকল্পনা অফিসে ১০৭টি মায়ের ব্যাংক দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর-চট্টগ্রামের উপপরিচালক ডা. উ খ্যে উইন সমকালকে বলেন, 'প্রসূতিদের প্রসবের আগে-পরে একটি অর্থের প্রয়োজন হয়, যা অনেকের পক্ষে তাৎক্ষণিক জোগাড় করা সম্ভব হয় না। অর্থের অভাবে সঠিক সময়ে ডেলিভারি করাতে গরিব ও অসহায় প্রসূতিদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এ থেকে রক্ষা পেতে গর্ভধারণের পরপরই আমরা বিশেষ করে গরিব প্রসূতি নারীদের বিনামূল্যে মায়ের ব্যাংক তুলে দিচ্ছি।' তিনি জানান, স্ব স্ব এলাকার পরিবার পরিকল্পনা অফিসের কর্মকর্তারা মায়ের ব্যাংকের যাবতীয় বিষয় তদারকি করছেন। টাকা সঞ্চয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তাদের পরিবারের অন্য সদস্যরা যাতে আগ্রহী হন, সে জন্য তাদেরকে নানাভাবে উৎসাহী করা হয়। দেওয়া হয় নানা নির্দেশনাও।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা লিলা চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'গর্ভে সন্তান আসার দিনই অন্তঃসত্ত্বা মায়ের হাতে আমরা মায়ের ব্যাংক তুলে দিচ্ছি। প্রতিদিনের সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে যে যতটুকু পারে ব্যাংকে জমা করতে উৎসাহিত করছি। করোনার এমন সময়ে অনেকে সঞ্চয় করা টাকা দিয়ে সম্পন্ন করতে পারছেন ডেলিভারির যাবতীয় খরচ। একজনকে দেখে অন্যরাও মায়ের ব্যাংকে টাকা সঞ্চয়ে আগ্রহী হচ্ছেন।'
নিকটস্থ স্বাস্থকেন্দ্রে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের যাবতীয় তথ্য হালনাগাদ করা হয়। সঞ্চয় করতে উৎসাহিত করার কাজটি করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। কেউ অন্তঃসত্ত্বা হলে তার নাম-ঠিকানা পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীরা সংরক্ষণ করে রাখেন। সুরাইয়া বেগম বলেন, 'গর্ভবতী হওয়ার দিন পরিবার পরিকল্পনা অফিস থেকে একটি বিনামূল্যে প্লাস্টিকের ব্যাংক দেওয়া হয়। সেদিন থেকে প্রতিদিনের খরচ থেকে যতটুকু পারছি সঞ্চয় করছি। কোনোদিন ৫০ টাকা; কোনোদিন ২০০ টাকাও জমা রেখেছি। এভাবে সাড়ে ছয় মাসে ১০ হাজার ৯৭ টাকা জমেছে। বিপদের সময়ে এই টাকা আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আগামী কয়েক মাসে আশা করছি, আরও কয়েক হাজার টাকা জমবে।'
এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর স্বামী মো. আকমল বলেন, 'স্ত্রীর কাছে ব্যাংকে টাকা জমানোর কথা শুনে উৎসাহিত হই। প্রতিদিনের আয় থেকে কিছু টাকা তার হাতে দেওয়ার চেষ্টা করছি। সেই ব্যাংকে কয়েক মাসে ডেলিভারি সম্পন্ন করার মতো আশানুরূপ টাকা জমা হয়েছে। এ কারণে দুশ্চিন্তা থেকে মিলছে মুক্তি।'