সুখের সংসারে একমাত্র অভাব মা রেজিয়া

নিহত রেজিয়া বেগমের ছেলে নুরুন্নবীর করা গরুর খামার - সমকাল
মেরিনা লাভলী, রংপুর
প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২১ | ০২:০৩
সুখ আর স্বচ্ছন্দেই দিন কাটছে রেজিয়া বেগমের দুই সন্তানের। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত রেজিয়ার সন্তানদের নিয়ে যখন পরিবার দিশেহারা, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মমতামাখা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন পরিবারটির দিকে। গর্ভধারিণী মাকে হারালেও রেজিয়ার দুই সন্তান হারুন-অর-রশিদ ও নুরুন্নবীর দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই তাদের সংসারে এখন অভাব বলতে কিছু নেই। ক্ষেতখামার করে নিজ বাড়িতে পরিবার নিয়ে সুখেই বসবাস করছেন। তার পরেও প্রতিনিয়ত মায়ের অভাব বোধ করেন হারুন ও নুরুন্নবী।
গ্রেনেড হামলায় নিহতদের পরিবারকে তৎকালীন বিরোধদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এক লাখ টাকা করে অর্থ সহায়তা দিলে রেজিয়া বেগমের দুই সন্তানকে নিয়ে তার বাবা নিজ গ্রাম রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার গঙ্গানারায়ণ এলাকায় চলে আসেন। সেখানে ওই টাকা দিয়ে ২৪ শতক জমি কিনে রেজিয়ার বড় ছেলে হারুন-অর-রশিদকে তিন শতক, প্রতিবন্ধী ছোট ছেলে নুরুন্নবীকে ৯ শতক ও রেজিয়ার বাকি তিন বোনকে তিন শতক করে লিখে দেন রেজিয়ার বাবা। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দফায় দফায় অর্থ সহায়তা দেন রেজিয়ার দুই ছেলেকে। এতে পরিবর্তন আসে রেজিয়ার ছেলেদের জীবনে। তারা এখন সুখের সংসার করছেন।
দুই বছর আগেও রেজিয়ার ছোট ছেলে প্রতিবন্ধী নুরুন্নবীর খুপরি টিনের চালের বাড়ি ছিল। খড়ের ঘরে দেশি গরু পালন করতেন। বাঁশের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাড়ির পাশে রাস্তা দেখা যেত। ঘরের খুঁটিগুলোও ছিল নড়বড়ে। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া অনুদান থেকে কেনা ৯ শতক জমির শেষ সীমানা ঘেঁষে আধাপাকা উন্নতমানের গরুর ঘর তৈরি করেছেন নুরুন্নবী। খামারে ছয়টি উন্নতজাতের গরু রয়েছে। বাড়ির উঠানে হাঁস-মুরগি চষে বেড়াচ্ছে। গরুর আধাপাকা ঘর ছাড়াও আরও তিনটি টিনের ঘরে তৈরি করেছেন তিনি। একটিতে স্ত্রীসহ নিজে থাকেন, অন্যটি ছেলের জন্য।
নুরুন্নবীর স্ত্রী মর্জিনা বেগম জানান, প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের আরও বেশ কিছু টাকা ব্যাংকে রেখেছেন তারা। সেই টাকার সুদ, গরুর দুধ, গোবর, হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে আয় ছাড়াও প্রতি মাসে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন তার স্বামী নুরুন্নবী। তার একমাত্র ছেলে মাসুদ রানা (১৪) স্থানীয় বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে।
এদিকে নুরুন্নবীর বড় ভাই হারুন-অর-রশিদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম আরাজি শাহবাজপুরে তিন শতক জমির ওপর বাড়ি ছিল। গত বছর তিনি বাড়ির লাগোয়া আরও ৯ শতক জমি কিনে বাড়ি ভিটা বড় করেছেন। জমি বন্ধক নিয়ে চাষাবাদ বাড়িয়েছেন। তার সংসারেও অভাব নেই। একমাত্র মেয়ে হালিমা খাতুনকে (২৫) বিয়ে দেওয়ার পর এখন সুখের সংসার তার। কাজপাগল হারুন ভোর হতেই বেরিয়ে পড়েন নিজের জমিতে। নিজের গোলাভর্তি ধানই জোগান দেয় তাদের সারা বছরের খাদ্য। তার ওপর ব্যাংক থেকে পাওয়া সুদের টাকা প্রতি মাসে হাতে আসছে তার।
রেজিয়ার ছোট ছেলে নুরুন্নবী বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার নানার হাতে এক লাখ টাকা তুলে দিলে গ্রামে ২৪ শতক জমি কিনে বাড়ি করা হয়। এখানে আমাকে ৯ শতক, আমার বড় ভাইকে তিন শতক এবং আমার তিন খালার নামে ১২ শতক লিখে দেন নানা। এরপর ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী আমাদের দুই ভাইকে চার লাখ করে আট লাখ টাকা দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী আরও ১২ লাখ করে দুই ভাইকে ২৪ লাখ টাকা দেন। ওই টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করেছি। ব্যাংক থেকে মাসে মাসে টাকা পাই। সেটা দিয়েই সংসার চলে। এবার গরুর খামার বড় করেছি। ভালো আয়-উন্নতি হচ্ছে। আমার মা ২১ আগস্টে জীবন দিলেও প্রধানমন্ত্রী নিজ সন্তানের মতো আমাদের দায়িত্ব নিয়েছেন।'
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার স্মৃতিচারণ করে রেজিয়ার ছোট বোন আনোয়ারা বেগম (৪১) বলেন, চার বোনের মধ্যে রেজিয়া বেগম বড়। বাবা-মাকে নিয়ে রেজিয়া হাজারীবাগে বাড্ডায় পানির ট্যাঙ্কের কাছে থাকতেন। ভাই নেই, তাই বাবা-মা ও বোনদের দেখাশোনা তিনিই করতেন। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বাজার করে এনে রান্না করে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলেছিলেন, 'আমি আওয়ামী লীগের মিছিলে যাচ্ছি। তোমরা থাকো, আমার আসতে বিকাল হতে পারে।'
আনোয়ারা বেগম বলেন, এরপর বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হলেও রেজিয়া বাড়ি ফেরেননি। বাবা-মা দুশ্চিন্তা করতে থাকেন। আমি নিজেও আশপাশে খোঁজ করতে থাকি। এরই মধ্যে খবর আসে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলায় অনেক মানুষ মারা গেছে, আহত হয়েছে। চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও বোনকে পাইনি। পরে হাসপাতালের লাশঘরে গিয়ে দেখি বোনের মরদেহ রাখা। গোটা গায়ে রক্ত ছিল, পায়ের দিক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।