ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

উত্তপ্ত বরিশাল

মেয়র সাদিক কোণঠাসা, প্রশাসনও কাঠগড়ায়

মেয়র সাদিক কোণঠাসা, প্রশাসনও কাঠগড়ায়

শনিবার সন্ধ্যায় বরিশালে সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ - সমকাল

মসিউর রহমান খান

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২২ আগস্ট ২০২১ | ০৫:৩১

অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। বুধবার রাতে ইউএনওর বাসায় হামলার দুই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে তাকে। এ ইস্যুতে প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন ইউএনওর পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মেয়র সাদিকের পাশে নেই আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশসহ সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরও দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন মেয়রের সঙ্গে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা সরাসরি বরিশালের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেও এই ইস্যুতে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখছেন।

এদিকে, এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বৃহস্পতিবার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন 'বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন' যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে, তা নিয়েও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে নানা বিরূপ মন্তব্য লক্ষ্য করা গেছে। পাশাপাশি একাধিক সাবেক আমলাও নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন।

সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকাশ্যে এমন বিবৃতি দেওয়া মোটেই উচিত হয়নি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তো কোনো দলের নন, কারও বিপক্ষে নন।

একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংগঠনকে পুরোপুরি প্রতিপক্ষ বানানো হয়েছে। অথচ সরকারি কর্মকর্তারা কোনো রাজনীতি করেন না। এরপরও তারা রাজনৈতিক ভাষায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে কী ঘটেছিল, সে বিষয়টি আগে তাদের দেখা প্রয়োজন ছিল। সরকারি একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা হঠাৎ করে সিটি করপোরেশনের একজন মেয়রকে গ্রেপ্তার করার কথা বলতে পারেন না। প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বিষয়টি খুবই খারাপ হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের কাছেও বিতর্কিত হচ্ছেন তারা। এ সুযোগে প্রশাসন ক্যাডারের বিপরীত পক্ষ নানা সমালোচনা করছে।

বাংলাদেশ সার্ভিস রুলে বলা আছে- কোনো সরকারি কর্মকর্তা জনসমক্ষে কোনো রাজনৈতিক অথবা সরকারি কোনো অঙ্গ প্রশাসনিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে বিবৃতি দিতে পারবেন না। তবে কর্মকর্তাদের কল্যাণে কথা বলতে পারেন। সেটা হতে হবে শালীন ও মার্জিত ভাষায়।

বহুল প্রচলিত সরকারি কর্মচারী আইন বইয়ের লেখক সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া সমকালকে বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের যে ঐতিহ্য, সেটা ধরে রাখতে পারেনি। এই ঘটনার মাধ্যমে অপরিপকস্ফতার পরিচয় দিয়েছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নয় যে, এভাবে বক্তব্য দেবে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পুরো বিষয়টি দু'পক্ষের জন্য খুবই স্পর্শকাতর। একদিকে যেমন ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা এ বিষয়ে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। আবার 'বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন' যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, তা নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে এর আগে দেওয়া সব বিবৃতিতে সভাপতি ও মহাসচিবের যৌথ সই থাকলেও বৃহস্পতিবারের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সভাপতি কবির বিন আনোয়ার একাই সই করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের মহাসচিব ও ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার খলিলুর রহমান গতকাল রাতে সমকালকে বলেন, ওই দিন তিনি নারায়ণগঞ্জে ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সভাপতি কবির বিন আনোয়ারের অফিসিয়াল সেল নম্বর ও ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি।

অনেকেই বলছেন, বরিশাল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মধ্যে প্রশাসন ঢুকে পড়েছে। প্রশাসন ক্যাডারদের সভাপতি কবির বিন আনোয়ার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব। আর এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরিশাল সদর আসনের এমপি জাহিদ ফারুক। প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক সুখকর নয়, এ খবর বরিশালের রাজনীতিতে অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। ঘটনার দিন রাতে উপজেলা প্রশাসনের চত্বরে লাগানো শোক দিবসের ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণের জন্য সিটি করপোরেশন ও মেয়রের ব্যক্তিগত লোকজন যৌথ অভিযান চালায়। ওই পোস্টার ও ব্যানারগুলো ছিল প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের পক্ষ থেকে লাগানো। প্রথম দফায় তর্কাতর্কির একপর্যায়ে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদককে আটকে রাখে ইউএনওর লোকজন। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আওয়ামী লীগসহ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফের উপজেলা প্রশাসনে ঢুকে পড়েন তাকে ছাড়িয়ে আনতে। এরপরই শুরু হয় তুলকালাম।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মেয়রের পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশালের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যখন সক্রিয় ছিলেন, তখন তার সঙ্গে রেষারেষি ছিল প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরনের। হিরনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এমপি নির্বাচিত হলেও রাজনীতিতে শক্ত কোনো ভিত গড়তে পারেননি। এরপর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছেলেকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। অনেকটাই নতুন মুখ হিসেবে মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়ে যান সাদিক আবদুল্লাহ। ছেলে নির্বাচিত হওয়ার পরে বরিশালের রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, সদর আসন থেকে জাহিদ ফারুক এমপি নির্বাচিত হলেও তিনি নিজেকে দলীয় কাজে কখনোই মেলে ধরতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান মেয়র সাদিক। একইভাবে বরিশালের রাজনীতিতে আগে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকলেও এখন আর এ ব্যাপারে মনোযোগ নেই উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের। মেয়র সাদিকের একক আধিপত্য বিস্তারের কারণে এসব সিনিয়র নেতাসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই এখন বরিশালের রাজনীতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন।

বুধবার রাতের ঘটনা নিয়ে সমকালের পক্ষ থেকে গতকাল রাতে আমির হোসেন আমু ও জাহাঙ্গীর কবির নানকের মন্তব্য জানতে চাইলে তারা দু'জনই কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। বর্ষীয়ান নেতা আমু বলেন, ঘটনা সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত জানেন না। তাই কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না।

এদিকে বুধবারের রাতের ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলার আসামি মেয়রের পক্ষের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ সাইয়েদ আহমেদ মান্নাকে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এই মামলায় মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকেও আসামি করা হয়েছে। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করছে, মামলার অন্য আসামিদের ধরতে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। তবে মেয়রের পক্ষ থেকে আর বাড়াবাড়ি না করা হলে গ্রেপ্তারের মতো কঠোর অবস্থানে যাবে না প্রশাসন। তাকে আদালতের মাধ্যমে জামিন লাভের সুযোগ দেওয়া হবে।

অন্যদিকে মেয়র সাদিক চাপে থাকায় গতকাল অনেকটা নির্বিঘ্নে দলীয় কর্মসূচি পালন করেছেন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের পক্ষের দলীয় কর্মীরা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভেচ্ছা উপহার বিতরণে জাহিদ ফারুকের পক্ষে অংশ নেন মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন, সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মীর আমির উদ্দিন মোহন, ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমির বিশ্বাস, ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউর রহমান বিপ্লব, ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক বাহার, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও শ্রমিক নেতা সুলতান মাহামুদ হাওলাদার, ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মনিবুর রহমান, ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আক্তার হোসেন রিপন, মহানগর যুবলীগের সদস্য মিজানুর রহমান প্রমুখ।

আরও পড়ুন

×