রেলওয়ে ঋণদান সমিতিতে প্রতারণার ফাঁদ
ঋণ না মিললেও কিস্তির টাকা দিতে হচ্ছে বেতন থেকে
মিজানুর রহমান
তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৪:১৮
সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে ঋণদান সমিতিতে আবেদন করেছিলেন রেলের ওয়েম্যান বিশু ঘোষ। নানা প্রক্রিয়া শেষে তার নামে ঋণ মঞ্জুর হয়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি তার নামে ব্যাংক চেকও (ক্যাশ চেক) ইস্যু হয়। সমিতির নিয়মানুসারে ১০ শতাংশ টাকা কেটে রেখে তার নামে তিন লাখ ১৩ হাজার ১৮০ টাকার এই চেক ইস্যু করা হয়।
কিন্তু এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন বিশু ঘোষ। পরের মাসে ঋণের বিপরীতে তার অ্যাকাউন্ট থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা কেটে রাখা হয়েছে দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান। পরে চট্টগ্রামের সিআরবিতে রেলওয়ে ভবনে সমিতি অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগযোগ করেন তিনি। জানতে পারেন, তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ মঞ্জুর হওয়ার পর ব্যাংক চেক ইস্যু হয়েছে এবং ব্যাংক থেকে টাকাও তুলে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হলে সমিতির সদস্যদের মধ্যে তোলপাড় দেখা দেয়।
এ সময় জানা যায়, একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন রেলের অফিস সহকারী পদের কর্মচারী কামরুন্নাহার, নিরাপত্তা প্রহরী আবুল কালাম ও মেটেরিয়াল চেকার কামরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন কর্মচারী। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সমিতির পরিচালক মিজানুর রহমানই ব্যাংক থেকে এভাবে ঋণের টাকা তুলে নিয়েছেন। রেলওয়ে শ্রমিক লীগের (সিরাজুল ইসলাম গ্রুপ) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর এভাবে রেল কর্মচারীদের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি সমিতি থেকে তিন লাখ ১৩ হাজার ৪৮৫ টাকার চেক ইস্যু করা হয় কামরুন্নাহারের নামে। তিন লাখ ১৭ হাজার ৪৮৫ টাকার চেক ইস্যু করা হয় আবুল কালামের নামে। আর এক লাখ ৮৫ হাজার ৫৫০ টাকা ঋণের চেক ইস্যু করা হয় কামরুল ইসলামের নামে। প্রতারণার শিকার কর্মচারীদের মধ্যে এই চারজন সমিতির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সমিতির পরিচালনা বোর্ড অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে। এখন টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেছেন সমিতির কর্মকর্তারা।
অভিযোগ, মিজানুর রহমান রেলওয়ে শ্রমিক লীগের ক্ষমতাধর নেতা হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। কয়েকজন সদস্য শ্রমিক লীগের সিনিয়র নেতাদের মাধ্যমে দেনদরবার করে টাকা আদায় করলেও নীরবে চোখের পানি ফেলছেন ক্ষমতাহীন অসহায় রেল কর্মচারীরা।
প্রতারণার শিকার বিশু ঘোষ সমকালকে বলেন, 'বিপদে পড়ে সমিতি থেকে ঋণ নিতে আবেদন করেছিলাম। হ্যাঁ, না কোনো কিছুই আমাকে জানানো হয়নি। তারপর বেতন থেকে টাকা কাটা গেছে দেখে রেলের হিসাব শাখায় খোঁজ করে জানতে পারি, ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। আর সেই ঋণের টাকাই কিস্তি হিসেবে কেটে নেওয়া হচ্ছে। সমিতি অফিসে গিয়ে জানতে পারি, আমার নামে মঞ্জুর করা ঋণের চেক সমিতির পরিচালক মিজানুর রহমানের কাছে দেওয়া হয়েছে। তিনিই টাকা তুলে নিয়েছেন। বিষয়টি জানিয়ে সমিতির কাছে অভিযোগ করলেও এখনও টাকা বুঝে পাইনি। এভাবে আমার মতো আরও অনেকের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।' মাসের পর মাস ঘোরাঘুরি করেও টাকা পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন কামরুন্নাহার, আবুল কালাম এবং কামরুল ইসলামও।
রেলওয়ে ঋণদান সমিতির সদস্য সচিব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, 'একজন পরিচালকের অপকর্মের কারণে পুরো সমিতি প্রশ্নেম্নর মুখে পড়েছে। সমিতির সদস্যদের যাতে অর্থ ও সময় নষ্ট না হয় এ জন্য অনেক সময় সংশ্নিষ্ট এলাকা থেকে নির্বাচিত পরিচালকের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা সদস্যের কাছে চেক পাঠানো হয়। এটা বোর্ড সভায় অনুমোদিত সিদ্ধান্ত। কিন্তু সমিতির পরিচালক মিজানুর রহমান কয়েকজন সদস্যের চেক পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নিজেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। সমিতির পরিচালনা বোর্ড সেই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। মিজানুর রহমানের পরিচালক পদও স্থগিত করা হয়েছে। একই তথ্য দিয়েছেন সমিতির সহকারী সচিব মোকছেদুর রহমানও।
তবে মিজানুর রহমানের মতে, বিষয়টি 'ভুল বোঝাবুঝি' ছাড়া অন্য কিছু নয়। তিনি বলেন, 'ঋণের কিছু টাকা নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। এটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে হয়েছে। তবে সেটা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
বাংলাদেশ রেলওয়ে ঋণদান সমিতি রেলের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঋণ দিয়ে থাকে। ব্যাংকের চেয়েও বেশি সুদ আদায় করে এই সমিতি। ১৪ শতাংশ সুদে এই ঋণ দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয় এবং চক্রবৃদ্ধি আকারে সুদ আদায় করা হয়। তারপরও কাগজপত্রের কড়াকড়ি না থাকায় রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই ঋণ নিয়ে থাকেন। সমিতি থেকে ছয় হাজার ৪০০ জন সদস্য ঋণ নিয়েছেন। এদের সিংহভাগই কর্মচারী। বর্তমানে সমিতির কোষাগারে জমা রয়েছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা। ঋণ মঞ্জুরে সমিতির এক শ্রেণির পরিচালক ও কর্মকর্তাদের ১৫ থেকে ২০ হাজার করে ঘুষ দিতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
- বিষয় :
- প্রতারণার ফাঁদ
- মিজানুর রহমান
- চট্টগ্রাম