ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

‘ওরা শুধু হামার মন্দির ভাঙে নাই, মনও ভাঙছে’

‘ওরা শুধু হামার মন্দির ভাঙে নাই, মনও ভাঙছে’

মন্দিরে এখনও পুলিশ পাহারা, ছবি: সমকাল

উলিপুর (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ০৭:৩৬ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ০৭:৩৬

‘মায়ের ভোগে উপবাস করেও মায়ের পূজা করতে পারিনি সেই কষ্ট ভুলতে পারি না বাবা। ওরা শুধু হামার মন্দির ভাঙে নাই, মনও ভাংছে, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নষ্ট করছে।’ কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পশ্চিম কালুডাঙ্গা গ্রামের জোনাকু চন্দ্র বর্মনের স্ত্রী পুস্পরানী বর্মনী (৫৫)।

ওই গ্রামের সুনতি বর্মনী বলেন, খাই দাই কিন্তু শান্তি পাই না। রাতের ঘুম যেন হারাম হইছে। সে দিনের আতঙ্ক ভুলতে পারি না।

নেফরা গ্রামের ফনিন্দ্র নাথের স্ত্রী বৃদ্ধা সৈইল বালা (৬৫) চোখের পানি ঝড়িয়ে বলেন, সম্পদের ক্ষতিপূরণ দিলে কী মনের কষ্ট যায় বাবা। ৭১-এ যা হয় নাই, সেদিন তার চেয়ে বেশি হইছে।

কুমিল্লায় মন্দিরে কোরআন শরীফ রাখার ঘটনার জেরে গত ১৪ অক্টোবর উলিপুর উপজেলার থেতরাই ও গুনাইগাছ ইউনিয়নের পশ্চিম কালুডাঙ্গা সার্বজনীন দেবী মন্দির, ব্রা‏হ্মণপাড়া দুর্গা মন্দির, নেফরা দুর্গা মন্দির ও হোকডাঙ্গা ভরতপাড়া দুর্গা মন্দিরসহ সাতটি মন্দিরে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হিন্দু বাড়ি ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার চার দিন পর ১৭ অক্টোবর পুলিশ বাদী হয়ে চারটিসহ মোট পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়।

ভিডিও ফুটেজ দেখে থেতরাই কৃষক লীগের সভাপতি মকবুল হোসেনসহ এখন পর্যন্ত ৫৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গত এক নভেম্বর সরেজমিন দেখা যায়, পশ্চিম কালু ডাঙ্গা ও ভরতপাড়া গ্রামে এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। মন্দিরে নিরাপত্তা চৌকি বসিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়েছে আশপাশের কয়েক গ্রামের মুসলমান পুরুষ। ঘটনার ১৮ দিন পরও হিন্দু পরিবারগুলো ভুলতে পারছে না সেই দিনের ভয়াবহ ঘটনা। পুরো এলাকা ঘুরে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল হিন্দুদের মধ্যে এখনও ভীতি কাটেনি ও স্বাভাবিক হয়নি তাদের জীবনযাত্রা।

সাতদরগা বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুস সবুর (৫০) জানান, সেদিন এখান থেকে যারা মিছিল করে হিন্দুদের মন্দির, বাড়ি ভেঙেছে, হামলা করেছে তারা মুসলমান হতে পারে না। ওদের কঠিন বিচার হওয়া উচিত।

মন্দির কমিটির সভাপতি শ্রী মন মহন রায় জানান, ওই রুহুল মেম্বারের সামনে তার ভাতিজা বিএনপি নেতা আনোয়ারুল ইসলাম (নয়ন) ও আকতারুল ইসলাম মন্দিরে ঢুকে সব লাইট বন্ধ করে দিলে, রিয়াজুল ইসলাম, আহসান ও আলমগীর হোসেনসহ মিছিলকারীরা ভাঙচুর, হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে পরিবার নিয়ে আমরা পালিয়ে জীবন বাঁচাই।

প্রবীর কুমার সরকার (৬০) জানান, আমরা মসজিদের ঈমাম সাহেবের কাছে নামাজের সময়সূচি নিয়ে পূজা করি যাতে নামাজের কোনো অসুবিধা না হয়। তবু এই নারকীয় ঘটনা ঘটাল। আমরা এ ঘটনার সুবিচার দাবি করছি।

থেতরাই আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল জলিল এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, যারা এর সঙ্গে জড়িত তারা আমার দলের হলেও শাস্তি চাই।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ উলিপুর শাখার সভাপতি সৌমেন্দ্র প্রসাদ পান্ডে গবা উলিপুরের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সম্প্রতি নষ্টকারীদের দ্রুত বিচার দাবি করেন। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষায় ওই গ্রামগুলোতে সম্প্রতি সভা করার আহবান জানান।

সংসদ সদস্য অধ্যাপক এমএ মতিন জানান, ঘটনার পর সার্বিক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছি। পুলিশ প্রশাসন দেষীদের গ্রেপ্তারে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আসন্ন সম্প্রীতি সভায় রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নিলে ভীতি কাটবে।

উলিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমতিয়াজ কবির জানান, ভিডিও ফুটেজ ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের মাধ্যমে আসামি গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। তবে কোনো নিরাপরাধ মানুষকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আগামী রোববার থেকে ওই এলাকাগুলোতে সম্প্রীতি সভা করা হবে।

আরও পড়ুন

×