- নারী দিবস
- বিকশিত প্রজন্ম গঠনে চাই বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা
মানবসম্পদ
বিকশিত প্রজন্ম গঠনে চাই বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা

এ বছর অগ্নিঝরা মার্চ মাস এমন সময় এসেছে, যখন পাঠ্যপুস্তকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলন বিষয়ে নতুন করে আলোচনা উঠেছে। আমাদের মনে থাকার কথা, রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা এসেছিল। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে অর্ধশতাব্দীকাল আগে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু আজও বৈষম্য-বঞ্চনাহীন, যুক্তিভিত্তিক একটি সমাজ গঠন করতে পারিনি। পারিনি নারী নির্যাতনমুক্ত একটি রাষ্ট্র গঠন করতে। কারণ, আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য-বঞ্চনার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সচেতনতা দেয় না। সব নাগরিকের সমান অধিকার বিষয়েো স্পষ্টতা দেয় না। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা তৈরি করে না।
উল্লেখ করা যায়, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ব্রিটিশ-পাকিস্তানি শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মোটেই আশাবাদী ছিলেন না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং বিকশিত মানুষ সৃষ্টির পরিবর্তে এটি শুধু কেরানি তৈরি করছে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শাসন ও শোষণ করার জন্য একটি আমলাগোষ্ঠী তৈরি করা। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করাও তাঁর আধুনিক রাষ্ট্র গঠন উপযোগী নাগরিক তৈরির আগ্রহ স্পষ্ট করে। দুর্ভাগ্যজনক, আমরা এখনও বিকশিত মানুষ তৈরি করার মতো একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। নানা বিরুদ্ধ সমালোচনার মুখে সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রণীত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি পাঠ্যপুস্তক প্রত্যাহার করতে বাধ্য হওয়ার ভেতর দিয়েও অবস্থাটা বোঝা যায়।
যাঁরা পাঠ্যপুস্তকে বিবর্তনবাদ ও মাসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে বই দুটির সমালোচনা করেছেন, তাঁরা এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই বেরিয়ে এসেছেন। যদি প্রচলিত শিক্ষা মুখস্থবিদ্যার বাইরে যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে কোনো কিছু মূল্যায়ন করার যোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হতো, তাহলে তাঁরা এর বিরোধিতা করাকে মতলববাজি মনে করতেন। উল্লেখ বাহুল্য নয়, সামরিক শাসনকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে প্রথম ডারউইনের বিবর্তনবাদ বাদ দেওয়া হয়েছিল।
সমাজে একটি গোষ্ঠী প্রচার করে– বিবর্তনবাদ বলে, ‘মানুষ বানর থেকে এসেছে।’ বিতর্কিত বইয়ের কোথাও এ রকম দাবি করা হয়নি। বরং পরিষ্কারভাবে বইয়ে সে ধারণা খারিজ করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান-এর অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের ‘মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে?’ অংশে বলা হয়েছে, ‘অনেকে বলেন, মানুষের উদ্ভব হয়েছে নাকি বানর থেকে। এ কথা ভুল।’ আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মনে রাখতে হবে, বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি।’
বইয়ে বিবর্তনবাদ যুক্ত হয়েছে সময় ও পরিবেশ-প্রতিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকূল পরিবেশে প্রাণিকুলের নিজ নিজ প্রজাতি ও আন্তঃপ্রজাতির মধ্যে টিকে থাকার প্রয়োজনে খাপ খাইয়ে নেওয়া সম্পর্কে ধারণা দিতে। এই মতবাদ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিবর্তনের রীতির বাইরে কিছুই নেই। প্রাণিকুলের পাশাপাশি সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বিবর্তিত হচ্ছে বা বদলাচ্ছে– এটা তো আর মিথ্যা নয়। এই ধারণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যদি কোনো প্রশ্ন তৈরি করে, তবে তা চিন্তাচর্চায় ইতিবাচক পরম্পরা তৈরি করবে। তা ছাড়া এই শিক্ষার্থীরাই বড় হয়ে চিকিৎসক, জীববিজ্ঞানী, কৃষিবিজ্ঞানী বা রসায়নবিদ হবে। বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা না নিয়ে তারা চিকিৎসাবিদ্যা, কৃষিবিদ্যার উচ্চতর পাঠ বা আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন সম্পন্ন করতে পারবে না।
পাঠ্যপুস্তকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা নিয়েও অনেকের আপত্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাঁরা হয়তো মনে রাখেন না, আমাদের দেশের মেয়েরা ৯ থেকে ১১ বছর বয়সেই প্রথম ঋতুস্রাবের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। যে মেয়েরা প্রথমবার এই অভিজ্ঞতা অর্জনের আগে এ সম্পর্কে ধারণা পায় না, তারা কী ভয়াবহ আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মুখে পড়ে, সেটা যে কোনো ভুক্তভোগী মেয়েই বলতে পারবে। এটা প্রমাণিত– আমাদের মেয়েদের বেশিরভাগ স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও অসুস্থতা যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অব্যবস্থাপনা থেকেই শুরু হয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ধারণা কেন স্কুলেই দিতে হবে? কেন বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নয়? কিন্তু নানা সংস্কার ও অজ্ঞানতার কারণে আমাদের দেশের অভিভাবকরা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তাদের কৈশোরকালীন শারীরিক পরিবর্তন বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। এমনকি কোনো কিশোর-কিশোরী সাহস করে কোনো কিছু জানতে চাইলেও নানা রূপকথার গল্প শুনিয়ে দেওয়া হয় বা ধমক দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হয়। স্কুলে এই পাঠ চালু থাকলে শুধু শিক্ষার্থীদের সামনে সুযোগ উন্মোচিত হতে পারে শিক্ষক ও অভিভাবকের কাছে প্রশ্ন করে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করার।
আমরা জানি, আমাদের প্রচলিত শিক্ষায় অনেক ধারা রয়েছে, তার মধ্যে মোটা দাগে তিনটি ধারা প্রধান। মূলধারার শিক্ষার বাইরে একটি ধারা হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা, অন্যটি ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষা। এই তিনটি শিক্ষাধারার সিলেবাস থেকে শুরু করে পাঠ পদ্ধতি, সুযোগসুবিধা– সবকিছুতেই অনেক পার্থক্য। মূলধারার শিক্ষাধারায় জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হলেও মাদ্রাসা শিক্ষায় জাতীয় শিক্ষাক্রমের তুলনায় ধর্মীয় ভাবধারার পারলৌকিক বিষয়কেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় সর্বাপেক্ষা আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের অগ্রসর ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
আমাদের দেশে এমনিতেই শ্রেণিবৈষম্য প্রকট। প্রধানত তিন ধারার শিক্ষা বিদ্যমান বৈষম্যকে আরও প্রকটতর করে তুলছে। আমরা যখন জাতীয় পাঠক্রম থেকে বিবর্তনবাদ, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা বাদ দিচ্ছি, তখন ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়ছে তারা ঠিকই এসব বিষয়ে শিখছে ও চিন্তাচেতনায় এগিয়ে থাকছে। আবার মূলধারার শিক্ষা থেকে আমরা অন্তত কেরানি হবার উপযোগী হয়ে উঠতে পারলেও মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্তরা সে সুযোগ থেকেও দূরে থাকতে বাধ্য হয়। এর ফলে তিন ধারা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্তরা সমাজে তিন ধরনের উপযোগিতা অর্জন করে এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রেও এই তিন দলের সক্ষমতার হেরফের হয়।
আমাদের দরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুকূলে বৈষম্যমুক্ত একটা অগ্রসর সমাজ। এ জন্য চাই যুক্তিনিষ্ঠ, বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাচেতনার মানুষ তৈরির উপযোগী শিক্ষা, বঙ্গবন্ধু যাকে বলেছেন বিকশিত মানুষ তৈরির শিক্ষা। যে শিক্ষা অন্ধভাবে গুজবের পেছনে ছোটা মানুষ তৈরি করে; যে শিক্ষা বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যুক্তি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়; আমাদের সেই শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে মন দেওয়া প্রয়োজন। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, জন্মস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে মানুষে মানুষে বৈষম্য কমিয়ে একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আগামীর পৃথিবীতে টিকে থাকার উপযোগী একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলায় মনোযোগ ও সম্পদ বিনিয়োগকে এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই বিবেচনা করতে হবে।
রোকেয়া কবীর: মুক্তিযোদ্ধা ও নারীনেত্রী; নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ
মন্তব্য করুন