ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঢাকার বুকে বিস্মৃতির আড়ালে শহীদ সলিমুল্লাহ

ঢাকার বুকে বিস্মৃতির আড়ালে শহীদ সলিমুল্লাহ

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৪:৪৭

রাজধানী ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা মোহাম্মদপুরে গেলে দেখা যায়, বেশিরভাগ সড়কের নামই রাজা-বাদশাহর নামে। বাদ যায়নি সম্রাজ্ঞী ও মহাকবির নামও। তবে মোহাম্মদপুরে দুটি ব্যতিক্রমী সড়ক রয়েছে, যার নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

সংসদ ভবন থেকে মোহাম্মদপুরের দিকে যেতে প্রথমে আসবে শহীদ আসাদ গেট, যেটি ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনে শহীদ আসাদের নামে। আরও একটু এগিয়ে টাউনহল বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে রয়েছে আসাদ অ্যাভিনিউ-তাজমহল রোডের সংযোগ সড়ক শহীদ সলিমুল্লাহ রোড। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ শহীদ হন।

অবশ্য শহীদের নামে হওয়া দুটি সড়কে গেলে প্রায় সর্বত্রই নজরে আসবে আসাদ অ্যাভিনিউ বা সলিমুল্লাহ রোড। স্থানীয়দের অধিকাংশই 'শহীদ' শব্দটি ভুলতে বসেছেন। পাকিস্তান আমলে বর্তমান শহীদ সলিমুল্লাহ রোডের নাম ছিল 'কায়দে আজম' রোড। ১৯৭২ সালে ওই নাম পরিবর্তন করে মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ শহীদ সলিমুল্লাহ নামকরণ করে। পরে এটি সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায়।

নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না শহীদ আসাদ ও শহীদ সলিমুল্লাহর আত্মত্যাগের কথা। অনেকে সলিমুল্লাহ রোডের নামকরণের সঙ্গে আঠারো ও উনিশ শতকে ঢাকার চতুর্থ নবাব খাজা সলিমুল্লাহ বা নবাব সলিমুল্লাহকে বোঝেন। সরকারি তালিকায়ও নেই শহীদ সলিমুল্লাহর নাম। এর দায় কার? স্বাধীনতার ৫১ বছর পর বিষয়টি নিয়ে এমন প্রশ্ন তুলেছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের দুই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব সাদী মহম্মদ ও শিবলী মোহাম্মদ। একজন গানের মানুষ, অন্যজন নাচের জন্য স্বনামধন্য। তাঁদের বাবা হলেন শহীদ মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ। তিনি শায়িত মোহাম্মদপুর কবরস্থানে।

ক্ষোভ নিয়ে সাদী মহম্মদ সমকালকে বলেন, 'আমার বাবা শহীদ হয়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে একটিই সম্মান পেয়েছেন। তাঁর নামে মোহাম্মদপুরে একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে। আমরা আর কিছু পাইনি।'

মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ ১৯২৪ সালে চাঁদপুরের কচুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হাছান আলী সরকার, মা ওমর জান। তাঁরা তিন ভাই ও দুই বোন ছিলেন। ১৯৭১ সালে ঢাকায় তাঁর ঠিকানা ছিল মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের (সি-১২/১০) একমাত্র চারতলা বাড়ি। তখন সলিমুল্লাহ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় বাঙালি ও অবাঙালি সমন্বয় গঠিত কমিটির প্রধান ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তিনি তাঁর বাসার ছাদে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ছিলেন। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নানা পর্যায়েরও মিটিং হতো তাঁর ওই বাড়িতে। ২৫ মার্চ রাতেও এখানে মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ে আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নুরে আলম জিকু, শেখ কামালসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকে ছিলেন। এদিন রাত ১২টার পর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করলে অনেকে তখন সলিমুল্লাহকে এলাকা ছাড়তে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি। বরং তিনি পরদিন শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়ে স্থানীয় মসজিদে যান। নামাজ শেষে বাড়িতে ফেরার পথে তাঁকে ধাওয়া করে অবাঙালিরা। পেছন থেকে গুলিও চলে। সলিমুল্লাহ প্রাণ বাঁচাতে বাড়িতে ফিরে বাথরুমে আশ্রয় নেন। অবাঙালিরা বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দোতলা থেকে লাফ দিয়ে পালাতে গিয়ে তাঁর স্ত্রীর দুটি পা ভেঙে যায়। সলিমুল্লাহ পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। ভীতসন্ত্রস্ত সলিমুল্লাহ দম্পতির ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ে দিজ্ঞ্বিদিক পালিয়ে যান।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সলিমুল্লাহর বড় ছেলে সাদী মহম্মদ সমকালকে বলেন, "বাবাকে পালাতে দেখে হাতে বিশাল একটি ড্যাগার নিয়ে ছুটে আসেন অবাঙালি এক প্রতিবেশী। তিনি এয়ারফোর্সে চাকরি করতেন। ওই প্রতিবেশী পেছন থেকে ধারালো ছুরিটা (ড্যাগার) বাবার কাঁধে বসিয়ে দেন। বাবা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে ধরতে চাইলে বাবা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন। বললেন, 'তুই পালা।' তখন দেয়াল টপকে পাশের বাসার উঠানে ঢুকতেই দেখি, ১৫-২০টা লাশ পড়ে আছে। সেখান থেকে পালিয়ে বছিলার দিকে আমাদের সলমসি গ্রামের বাড়িতে চলে আসি, পরে বাবা ছাড়া পরিবারের অন্যদের সঙ্গে এখানে দেখা হয়।"

শিবলী মহম্মদ জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় বাসার পাশের মসজিদের ইমামের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা আরও অনেকের সঙ্গে তাঁর বাবার মৃতদেহ মোহাম্মদপুর কবরস্থানে মাটিচাপা দিয়েছে। ওই জায়গাটিকে তাদের পরিবার এখন শহীদ সলিমুল্লাহর কবর হিসেবে জানে।

সলিমুল্লাহকে হারিয়ে চরম বিপাকে পড়েন তার স্ত্রী জেবুন্নেছা সলিমুল্লাহ ও তাঁর ১০ সন্তান। তখন থেকেই সন্তানদের নিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু হয় ত?াঁর। তিনি সেলাইয়ের কাজ জানতেন। পরিবারের জীবিকা নির্বাহের জন্য এটিই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান অবলম্বন। বঙ্গবন্ধু সরকার শহীদ সলিমুল্লাহর পরিবারকে ২ হাজার টাকাসহ সমবেদনাপত্র দিয়েছিল। কিন্তু শহীদের সরকারি তালিকায় তাঁর নাম নেই। মোহাম্মদপুরের বাড়িটি সংস্কারের পর ১৯৭৪ সালে সেখানে ফেরে তাঁর পরিবার। সলিমুল্লাহ বাড়িটি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিল, যা নিয়ে মামলা করেন তাঁরা। পরে আদালতের রায়ে বাড়ির মালিকানা নিশ্চিত হয়।

জেবুন্নেছার বয়স এখন ৯৫। তিনি সমকালকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে এটা বড় প্রাপ্তি। ১০ সন্তানকেই শিক্ষিত করেছি। আর কিছু চাওয়ার নেই।

এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শহীদ সলিমুল্লাহর ছোট ছেলে শিবলী মোহাম্মদ সমকালকে বলেন, 'বাবা শহীদ হওয়ার পর মা সেলাইয়ের কাজ করে আমাদের ১০ ভাইবোনকে মানুষ করেছেন। মাকে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। আমাদের তখনই বরং রাষ্ট্রীয় সহায়তা দরকার ছিল। মা আমাদের সবাইকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করিয়েছেন। মাকে নিয়ে আমরা গর্বিত।'

তিনি আরও বলেন, 'বাবা ও ভাই দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। মামা ও ভাইয়ারাসহ পরিবারের অনেকে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমরা কখনও স্বীকৃতি বা ভাতার জন্য আবেদন করিনি। এ জন্য আমাদের অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী সরকারগুলো আমাদের দুই ভাইকে (সাদী ও শিবলী) কালো তালিকাভুক্ত করে রেখেছিল। শিল্পকলা একাডেমিতে নাচের শিক্ষক থাকা অবস্থায় আমাকে এমন অপদস্থ করা হয় যে, চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম।'

শহীদ সলিমুল্লাহর স্বীকৃতির বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, 'এর দায় রাষ্ট্রের। এটি জানা ছিল না। পরিবার সহযোগিত চাইলে আইনের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

আরও পড়ুন

×