ঢাকা বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি

বাচ্চুর নামও দেওয়া হচ্ছে অভিযোগপত্রে

বাচ্চুর নামও দেওয়া হচ্ছে অভিযোগপত্রে

শেখ আবদুল হাই বাচ্চু

হকিকত জাহান হকি

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ২০:৫৭

রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় অবশেষে ৫৬ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ সাত বছর চার মাস তদন্তের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই কেলেঙ্কারি মামলার অভিযোগপত্রে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম যুক্ত করেছে। তবে কয়টি মামলার অভিযোগপত্রে তাঁর নাম থাকছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই মেয়াদে ছয় বছর ব্যাংকটির শীর্ষ পদে ছিলেন। বাচ্চু যখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন ঋণের নামে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছিল। দুদকের তদন্ত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-১ অনু বিভাগের পরিচালক মো. আকতার হোসেন আজাদের তত্ত্বাবধানে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ৫৬ মামলার তদন্ত হয়। সংশ্নিষ্ট দুদক কর্মকর্তারা সবুজ সংকেত পেয়েই তদন্ত প্রতিবেদনও তৈরি করেছেন। ঋণের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাটের সঙ্গে বাচ্চু জড়িত ছিলেন বলে আমলযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার আগে দুদকের আইনজীবীরা তদন্ত প্রতিবেদনগুলো সর্বশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন। বাচ্চু চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে ওই সময়ের পর্ষদ সদস্যদের বিরুদ্ধেও অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁদের নামও অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই দুই মেয়াদে ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন ১২ জন। তাঁরা হলেন- ফখরুল ইসলাম, সুভাশীষ বোস, নীলুফার আহমেদ, কামরুন্নাহার আহমেদ, এ কে এম রেজাউর রহমান, এ কে এম কামরুল ইসলাম (এফসিএ), মো. আনোয়ারুল ইসলাম (এফসিএমএ), আনিস আহমেদ, সুরাইয়া বেগম, জাহাঙ্গীর আকন্দ সেলিম, সাখাওয়াত হোসেন ও ড. কাজী আখতার হোসেন। পর্ষদের সদস্য সচিবের দায়িত্বে ছিলেন কাজী ফখরুল ইসলাম। তবে দুদকের দায়ের করা ৫৬ মামলার কোনোটিতে একজন পরিচালককেও আসামি করা হয়নি।

দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান সমকালকে বলেন, 'শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, যে কোনো আর্থিক দুর্নীতি মামলার তদন্ত যাতে দ্রুত শেষ হয়, অভিযোগপত্র হয়- সে ব্যাপারে কমিশনের নজরদারি আগের চেয়ে বেড়েছে। আমরা চাইছি, সব মামলারই দ্রুত অভিযোগপত্র দিতে। বেসিক ব্যাংকও এর বাইরে নয়। ব্যাংকটির কেলেঙ্কারি ঘটনার অভিযোগপত্রের ব্যাপারেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি।'

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি মামলার তদন্তের গতি কমিয়ে দেওয়া বা বন্ধ রাখার তদবির কমিশনে এসেছিল কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, 'এ ক্ষেত্রে আমি কোনো তদবিরের মুখোমুখি হইনি।' অভিযোগপত্রের ব্যাপারে কমিশন কোনো আসামির পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে থাকবে কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এ ক্ষেত্রে আমরা আইনগত দিক বিবেচনা করব। ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো সহানুভূতি বা বিশেষ নমনীয়তা দেখানোর সুযোগ নেই। তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন যাচাই করে সঠিক পাওয়া গেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।'

দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন সমকালকে বলেন, বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ মামলার প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, বেসিক ব্যাংকে যে ধরনের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে অবশ্যই ব্যাংকিং রীতিনীতির বাইরে নজিরবিহীন দুর্নীতি বলা যায়। দুদক অপরাধীর অবস্থান ও পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে কেলেঙ্কারির মূল হোতাকে চিহ্নিত করে আইনের কাছে সোপর্দ করবে- এটাই মানুষের প্রত্যাশা। দীর্ঘ সময়েও ৫৬ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল না করায় দুদকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অর্থ আত্মসাৎকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা- ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার বড় একটি অংশ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, পরপর দুই মেয়াদে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থেকে প্রভাব খাটিয়ে পর্ষদ সদস্যদের ম্যানেজ করে ক্রেডিটসহ অন্য কমিটির প্রতিবেদনের তোয়াক্তা করেননি বাচ্চু। একই সঙ্গে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা সম্পর্কে যাচাই না করে অস্তিত্বহীন অনেক কোম্পানির নামে শত শত কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দিয়েছেন। এভাবেই ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।

দুদক সূত্র জানায়, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদক ৫৬ মামলা করে। ২০১৫ সালের ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ঢাকার মতিঝিল, গুলশান ও আগারগাঁও থানায় মামলাগুলো করা হয়। মামলায় ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ মোট ১২০ জনকে আসামি করা হলেও কোনো মামলায় বাচ্চুকে জড়ানো হয়নি। অথচ অর্থ আত্মসাৎকালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনিই।

ওই সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মধ্যে আরও ২ হাজার ৪৬৩ কোটি ৩৪ লাখ ৫ হাজার ৬৫৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চলছে।

জানা গেছে, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে বিগত দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পরে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত বিবরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। ওই চার বছর তিন মাসে ব্যাংক থেকে মোট ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়, যার সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাই নিয়ম না মেনে দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, গত সাত বছর চার মাসের তদন্তে তিন থেকে চারবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে ফাইল পড়ে ছিল বছরের পর বছর। বিগত দিনে দুদক যখনই বেসিক ব্যাংকের অভিযোগপত্র দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে, তখনই প্রভাবশালীরা তা থামিয়ে দিয়েছেন।

দুদক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির অর্থ আত্মসাতে যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাঁরা যেই হোক না কেন, তাঁদের নাম অভিযোগপত্রে যুক্ত করা হবে। তদন্তে বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতে সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ তৎকালীন পর্ষদ সদস্যদের নাম এসেছে। ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত নথিপত্রে যাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে, তাঁদের কোনোভাবেই রেহাই দেওয়া হবে না।

দুদকের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, কেলেঙ্কারির সময় ব্যাংক পরিচালনার সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী জড়িত ছিলেন। ঋণ জালিয়াতিতে তাঁদের হাত ছিল কিনা তা-ও দেখা হচ্ছে। দুর্নীতির প্রমাণ থাকার পরও তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হলে এই তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না।

দুদকের তদন্ত থেকে জানা গেছে, ওই সময় পরিচালনা পর্ষদের কর্তাব্যক্তির ইঙ্গিতে ব্যাংকিং নিয়মবহির্ভূত জালিয়াতিপূর্ণ ঋণপ্রস্তাব পাঠানো হয় প্রধান কার্যালয়ের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক ঋণ-সংক্রান্ত কমিটিতে। এ দুই কমিটি ঋণপ্রস্তাবগুলো ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে সেগুলো ওই সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামের কাছে জমা দিয়েছিল। পরে এমডি কমিটি দুটির মন্তব্য, সুপারিশসংবলিত প্রস্তাবগুলো বোর্ডে পেশ করেছিলেন। এভাবেই একের পর এক সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণপ্রস্তাব পেশ করা হয় পর্ষদে।

দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, অনুমোদন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋণের টাকা ছাড় করার জন্য ফোনে শাখা ব্যবস্থাপককে জানানো হয়। অনুমোদনপত্র শাখায় পৌঁছার আগেই টাকা ছাড় করা হয়। এর মধ্যে ডায়নামিক ট্রেডিং, এসএফজি শিপিং লাইন লিমিটেড, সিলভার কম ট্রেডিং, এশিয়ান শিপিং বিডি, সুরমা স্টিল লিমিটেড, তানজিলা ফ্যাশনসহ কিছু কোম্পানি হিসাব খোলার আগেই নগদ টাকা তুলে নেয়, যা ব্যাংকিং ইতিহাসে বিরল।

আরও পড়ুন

×