ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারক-আইনজীবী মুখোমুখি

ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতিতে বিচার প্রশাসন

ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতিতে বিচার প্রশাসন

প্রতীকী ছবি

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২২:৫৯

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবীদের নজিরবিহীন 'আদালত বর্জন' কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতির মুখে পড়েছে বিচার প্রশাসন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতের জেলা জজ শারমিন নিগার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের অপসারণ চেয়ে এই কর্মসূচি পালন করছেন আইনজীবীরা। জেলার ২৮টি আদালতে বর্তমানে বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বিচারপ্রার্থীরা, জামিনের শুনানি না হওয়ায় জেলার কারাগারেও চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে, দুই বিচারককে বদলি করা হলে জেলার অন্য ২৩ বিচারক 'গণবদলি' চাইবেন বলে বিচার প্রশাসনকে জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিচার প্রশাসনে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। এতে জটিলতা আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

এ বিষয়ে অধস্তন আদালতের বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব (জেলা ও দায়রা জজ) মো. মজিবুর রহমান সমকালকে বলেন, 'আমাদের অভিভাবক সুপ্রিম কোর্ট রয়েছেন, আইন মন্ত্রণালয় আছে। তাঁরা সবই দেখছেন। হাইকোর্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতের চলমান ঘটনায় দুটি কনটেম্পট (আদালত অবমাননা) রুল জারি করেছেন। আমরা চাই বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান হোক। বিচার বিভাগের সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকুক।'

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে জানা গেছে, আইনজীবীদের দাবির মুখে দুই বিচারককে আপাতত বদলি না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে চলমান ঘটনা বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন। প্রয়োজন হলে কঠোর অবস্থানে যাবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

গত ২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের এজলাসে হট্টগোল, বিচারক ও আদালতের কর্মচারীদের 'গালাগাল ও অশালীন আচরণের' অভিযোগ ওঠে। বিচারকের বিরুদ্ধে গত ১ ডিসেম্বর (অবকাশকালীন ছুটির আগের শেষ কর্মদিবস) আইনজীবীদের তিনটি মামলার শুনানি গ্রহণ না করার অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়া জেলা জজের সদ্য বদলিকৃত নাজির মমিনুল হকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে তাঁকে অপসারণ না করা এবং নাজিরকে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে জেলা জজের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি বিচারকদের সঙ্গে অশালীন আচরণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় দুই বিচারক লিখিতভাবে প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ করেন। পরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশক্রমে পৃথক অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চে পাঠানো হয়।

এ ঘটনায় গত মাসে প্রথম দফায় জেলার ২৪ আইনজীবীকে তলব করেন হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ। এর শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক এবং অ্যাটর্নি জেনারেলসহ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা হাইকোর্টকে বলেন, বিষয়টি আলোচনা করে সুরাহা করা হবে। পরে আগামী ১৪ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চে 'আদালত অবমাননা' সংক্রান্ত অভিযোগের পৃথক শুনানির দিন ধার্য করেন। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীরা এখনও দুই বিচারকের অপসারণ চেয়ে দ্বিতীয় দফায় আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করছেন।

এদিকে, আইনজীবীদের দাবির মুখে গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাজির মো. মমিনুল ইসলামকে চাঁদপুরে বদলি করা হয়। তাঁর পদে চাঁদপুরের মো. ছানাউল্যা তালুকদারকে নাজির হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তবে এর পরও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির আদালত বর্জন কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। প্রায় দেড় মাস ধরে দুই বিচারকের আদালত এবং প্রথম দফায় ৯ কার্যদিবস ও দ্বিতীয় দফায় দুই কার্যদিবস ধরে জেলার সব আদালত বর্জন কর্মসূচি চলছে। এ পরিস্থিতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতগুলোতে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে আইনজীবী ছাড়াই বিচারপ্রার্থীদের শুনানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে তাতেও বাধা দিচ্ছেন আইনজীবীরা। এমনকি রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটরসহ সরকারি কৌঁসুলিদেরও শুনানিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, বিচারকদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট সংগঠন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কর্মরত বিচারকদের 'বক্তব্য' জানানো হয়েছে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষুব্ধ অধস্তন আদালতের বিচারকরা সমকালকে বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতি আদালতের জায়গায় 'রেইনশেড' নির্মাণ করতে না পারায় দুই বিচারক ও নাজিরের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ এনেছে। এটি প্রমাণিত। পরিস্থিতি সামাল দিতে দুই বিচারককে বদলি করা হলে জেলার সব বিচারকই গণবদলি চাইবেন। ফলে সেখানে আর বিচারকাজ করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে না।

জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভুইঞা সমকালকে বলেন, 'দুই বিচারককে অপসারণ না করা পর্যন্ত আদালত বর্জন কর্মসূচি চলবে।'

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কর্মরত এক বিচারক বলেন, 'আমরা যে কী পরিমাণ অসহায় অবস্থায় রয়েছি, তা বলে বোঝানো যাবে না। আইনমন্ত্রী ও আইন সচিব দুজনের বাড়িই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায়। এটিকে পুঁজি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতি দাপট দেখাচ্ছে। মন্ত্রী-সচিবও বর্তমান পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে গেছেন। আইনজীবীরা কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করছেন না।'

এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, 'বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্ট কনটেম্পট রুল ইস্যু করেছেন। এটা বিচারাধীন ব্যাপার।' তবে সুপ্রিম কোর্ট, আইন মন্ত্রণালয় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালত সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে চলমান ঘটনা নিয়ে সংশ্নিষ্ট সবাই উদ্বিগ্ন। দফায় দফায় বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। আইনজীবীদের পক্ষ থেকে নেপথ্যের আলোচনায় দুই বিচারককে বদলি এবং হাইকোর্টের কনটেম্পট রুল প্রত্যাহারের দাবি রয়েছে।

আরও পড়ুন

×