- বাংলাদেশ
- মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে প্রক্রিয়াধীন সব আইন স্থগিতের দাবি সম্পাদক পরিষদের
মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে প্রক্রিয়াধীন সব আইন স্থগিতের দাবি সম্পাদক পরিষদের
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সম্পাদক পরিষদের আলোচনা সভায় এ দাবি জানিয়ে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন মতপ্রকাশের পথে অন্তরায়। অথচ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের স্বাধীনভাবে চিন্তা ও মুক্তভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত এই দিবসটি পালনে এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকাশক্তি’– এই আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আলোচনায় অংশ নেন ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, সমকাল সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক ও দেশ রূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। অন্যান্যের মধ্যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
মাহফুজ আনাম সভাপতির বক্তব্যে সাংবাদিকতার নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মোট ৯টি আইনের বিভিন্ন ধারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে অন্তরায়। নতুন করে আরও চারটি আইন করার প্রক্রিয়া চলছে। প্রেস কাউন্সিল আইনের খসড়াটা অফিসিয়ালি চেয়েও সম্পাদক পরিষদ পাইনি। তিনি সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে চারটি দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হচ্ছে– ১. স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যেসব আইন প্রক্রিয়াধীন, সেই প্রক্রিয়া এখনই স্থগিত করা। আইনগুলোর মধ্যে যেসব ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ব্যাহত করতে পারে, সেগুলো আইন থেকে বাদ দেওয়া। ২. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। যদি তা বাতিলে সরকারের কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে, তাহলে এমন একটি ধারা যুক্ত করতে হবে, যেখানে বলা থাকবে– এ আইন গণমাধ্যম, স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রযোজ্য নয়। সাংবাদিকতার কারণে আজ পর্যন্ত যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তার সাংবাদিকদের মুক্তি দিতে হবে। ৩. যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, সেটি সরকার উদ্যোগী হয়ে যেন একেবারেই মুছে ফেলে। ৪. সাংবাদিকতার সুরক্ষার জন্য একটি নতুন আইন করা যেতে পারে, যা সংবিধানের চেতনার মধ্যেই আছে।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু তাঁর আলোচনায় বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। যতক্ষণ না এটি বন্ধ করতে পারছেন, সংশোধন না করতে পারছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে মামলা দায়ের করবেন। অভিযোগ এলেই গ্রেপ্তার করে চালান দিয়ে কারাগারে পাঠাতে পারবেন না। জামিন পাওয়ার অধিকার থাকতে হবে। আর অবশ্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পর্যালোচনা এবং সংশোধন দরকার। এটি ঝুলিয়ে রাখা ঠিক না। তিনি সাইবার জগতের নিরাপত্তার বিধান ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন সাপেক্ষে সংস্কার করে এটিকে গণমাধ্যমবান্ধব করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, গণমাধ্যমে স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে দরকষাকষি চলতে পারে না। ডিজিটাল জগতের নিরাপত্তা বিধানের জন্যও দরকষাকষি চলতে পারে না। দুটোই থাকতে হবে। ডিজিটাল জগতের নিরাপত্তার বিধানও করতে হবে। গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতাও নিরাপদ করতে হবে। একই সঙ্গে বাকস্বাধীনতাও নিরাপদ করতে হবে।
তাসমিমা হোসেন বলেন, সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়। এখন পরিবেশটা এমন দাঁড়িয়েছে, কিছু বলতেও ভয় লাগে। গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা ঔপনিবেশিক আমল থেকেই চলে আসছে। ব্রিটিশ এমনকি পাকিস্তান আমলেও তা হয়েছে। মানিক মিয়া ১৯৬৯ সালে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, গঠনমূলক সমালোচনা করা হলেও তা আমাদের গায়ে লাগে। সঠিক কথাটা বলতে চাইলে কণ্ঠ রোধ করা হয়। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাদের আটক করে জেলে নেওয়া হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই সাংবাদিক। অথচ সংবিধানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগই এখন অপপ্রয়োগ। এই আইনে শিশুদেরও ভয় দেখানো হচ্ছে। কয়েক দিন আগে বগুড়ায় একজন বিচারক তাঁর কন্যার স্কুলে গিয়ে সহপাঠী শিশুকে এই আইনে মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়েছেন। পরে ওই বিচারককে প্রত্যাহার করা হয়। তিনি বলেন, আমাদের জীবদ্দশায় আমরা দেখেছি, পাকিস্তান আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। বহু মূল্যে আমাদের দেশের স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি। কোনোদিনও ভাবিনি, স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের আবার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হবে। পেশাদার সাংবাদিকদেরই ঐক্যবদ্ধ সক্রিয় হয়ে সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে হবে।
নূরুল কবীর বলেন. একদলীয় শাসনে কখনও ভিন্ন মতকে সহ্য করা হয় না। কর্তৃত্ববাদী কোনো সরকার কখনও সমালোচনা সহ্য করে না। তাই অনুনয়-বিনয় করে কোনো লাভ হবে না; দাবি জানিয়ে কাজ হবে না। তিনি বলেন, স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না। আদায় করে নিতে হয়। রাষ্ট্রে গণতন্ত্র থাকতে হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকতেই হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি দরকার গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য।
মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি ২৭ শতাংশই সাংবাদিকদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। আইনের ২৯টি জায়গায় নানা দুর্বলতা রয়েছে এবং সেগুলো পরস্পরবিরোধী। তাই আইনটি সংশোধন করে পিআইবি বা কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ থাকতেই পারে। তবে পেশার প্রয়োজনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
মন্তব্য করুন