মুক্তিযুদ্ধের কাব্য কথা গান

.
হামিম কামাল
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৯ | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:৩২
মানব বিবেক মূলত শান্তিকামী। তবু তার সব কাজ বিবেককে অনুসরণ করে না। বিবেকের জানালা যখন বন্ধ থাকে, শোষণের ক্ষেত্র তৈরি করে একদল মানুষ। শোষিতের দলে তখন ক্ষত্রিয়ের জন্ম হয়। যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানের অন্তঃরাষ্ট্র (ডিপ স্টেট) সাতচল্লিশে আবির্ভাবের শুরু থেকেই আধিপত্যবাদী ছিল। পূর্ববাংলার মানুষের মাঝে আলোকায়ন, নেতৃত্বায়ন কখনও উৎসাহিত ছিল না। কিন্তু প্রভাবশালীর ইচ্ছার বাইরেও প্রকৃতির নিজস্ব ইচ্ছা রয়েছে, সেই ইচ্ছা মজলুম-চালিত। প্রবল চাপে ও তাপেই পদার্থ সর্বাধিক দ্যুতিময় শক্তিমতি স্তর অর্জন করে এবং পূর্ববাংলার ক্ষেত্রেও তাই হলো। এত বিপুলা শক্তি বিকিরিত হলো যে, একটু নতুন দেশের জন্ম হলো। আমরা এখন সেই জন্মমাস অতিক্রম করছি।
শিল্পীরা মানুষের মনোজগতের জাগতিক। কবি ও গদ্যশিল্পীরা ভাবকে ভাষায় আকার দেন, চিত্রশিল্পীরা চিত্রকলায় তাকে বাঙ্ময় করেন, গীতিকার-সুরকার-সংগীতশিল্পী তাকে প্রেরণামন্ত্রে পরিণত করেন। সব শিল্পীর নয়, কোনো কোনো শিল্পীর চরম দুঃসময়েও বিবেকের বাতায়ন খোলা থাকে। সেই বাতায়ন খোলা অল্প ক’জন শিল্পীকেই আমরা আমাদের শক্তিকেন্দ্র হিসেবে পাই। মুক্তিযুদ্ধের কালেও পেয়েছিলাম। বিষয় বিস্তৃত, পরিসর স্বল্প। ইচ্ছা থাকলেও বহুনাম আক্ষেপসহ অনুচ্চারিত থেকে যাবে।
কাব্য
মনে পড়ছে শামসুর রাহমানের কথা। একাত্তরের জনযুদ্ধে আমাদের প্রধান রণকৌশল ছিল গেরিলাযুদ্ধ। শামসুর রাহমানের ‘গেরিলা’ কবিতার কয়েক ছত্র পড়া যাক—‘দেখতে কেমন তুমি?–অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে/ কুলুজি তোমার আঁতিপাঁতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে/ ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন/ করে খোঁজে প্রতি ঘর। পারলে নীলিমা চিরে বের/ করত তোমাকে ওরা, দিত ডুব গহন পাতালে।/ তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর...।’
কবিতাটি একাত্তরে লিখিত, পরে গ্রন্থিত হয় ’৭২-এ প্রকাশিত ‘বন্দি শিবির থেকে’ কবিতাগ্রন্থে। আরও মনে পড়ছে সিকান্দার আবু জাফরের ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতা। একাত্তরের মার্চে প্রকাশিত। কয়েকছত্র পড়া যাক—‘কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে কেউটে সাপের ঝাঁপি!/আমার হাতেই নিলাম আমার নির্ভরতা চাবি;/তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া,/তুমি বাংলা ছাড়ো।’
একাত্তরে কলকাতায় চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত আবদুল হাফিজ সম্পাদিত কবিতা সংকলন ‘রক্তাক্ত মানচিত্র’র কথাও ভোলা যাবে না। বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল কবিতাগুলো। ভাগগুলো : একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলাভাষা, বাংলাদেশ, ঊনসত্তরের বাংলাদেশ, এপার বাঙলা ওপার বাঙলা, বিদ্রূপ ঘৃণা ক্রোধ হরতাল মিছিল মৃত্যু ও সংগ্রাম। পর্যায়ভাগগুলো আমাদের তেইশ-চব্বিশ বছরের পুরো সংগ্রামের গতিরেখা যেন চিহ্নি করে দিয়েছিল।
কথা
একাত্তরের সব লেখা একাত্তরে প্রকাশিত হয়নি, তবু লোকের হাতে গেছে, গঠিত হয়েছে, কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে, যুক্তি সজ্জিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে আলোর মুখ দেখলেও, একাত্তরের জুন মাসে, চিন্তায় অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের নকশাখচিত, সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অগ্রন্থিত উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাতের নাম কেন করব না। আনোয়ার পাশাকে তো ওরা বিজয় দেখতে দেয়নি। ১৪ ডিসেম্বর তাঁকে শহীদ করা হয়। স্থির সময়ে বসে লেখার অপেক্ষায় থাকলে হয়তো পূর্ববাংলার এই সতেজ চিন্তার নকশা আর লেখা হতো না।
বিপুলা সাহিত্যশক্তি এসেছিল ওপার বাংলা থেকে। ওই এক আশ্রয় পেয়েছিলাম বলে এ ভূখণ্ডে যুদ্ধের রক্তরস আমরা সরবরাহ করে যেতে পেরেছিলাম। ২৫ মার্চ রাতে চিত্তরঞ্জন সাহা আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তধারা’র জন্ম হয় এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তেত্রিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বলা হয়, তার তুল্য একাত্তর-স্মারক আজও অনুপস্থিত। সে সময়ের কথা ও মননশীল সাহিত্যিকদের উজ্জ্বল নামগুলোর কয়েকটি— আহমদ ছফা, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবু সায়ীদ, ধনঞ্জয় দাশ, জহির রায়হান, জাফর সাদেক, আনিসুজ্জামান, যতীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, বদরুদ্দীন উমর, হাসান হাফিজুর রহমান, আবুবকর সিদ্দিক, গাজীউল হক।
গান
গানের ক্ষেত্রে তিনটি প্রসঙ্গ উজ্জ্বলতর। এক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র; দুই, বাংলাদেশ মুক্তি-সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা; তিন, কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্ভবত সর্বাধিক প্রচারিত সংগীত– জয় বাংলা, বাংলার জয়। কিছু শিল্পী ভবিষ্যৎদর্শী। গাজী মাজহারুল আনোয়ার এ সংগীত ’৭০ সালে রচনা করেন যদিও, ’৭১-এ তা ছিল প্রাণের রসদ।
এমন রসদ আরও দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ের তরুণ গোবিন্দ হালদার। কামাল লোহানীর আহ্বানে নতমুখে এসে দাঁড়িয়েছিলেন গানের খাতা ‘জয় বাংলার গান’ নিয়ে। সেখানে লেখা ছিল ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’। আপেল মাহমুদ সুর দিলেন প্রথমটির, দ্বিতীয়টিতে সুর বসালেন সমর দাস। যাঁর নামে মানুষ যুদ্ধ করেছে, সেই শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা হলো অংশুমান রায়ের অমর সংগীত– ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে...’। বিপুল শক্তি সঞ্চারিত করেছিল আবুল কাসেম সন্দ্বীপের– ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’। আর গানের আকাশ ছেয়ে রেখেছিলেন কাজী নজরুল। কারার ওই লৌহ কপাট, চল্ চল্ চল্। যুদ্ধদিনে এসব গান অশ্রু সংবরণ করে আগুনে ঝাঁপ দিতে শিখিয়েছিল। এসেছিল মুক্তি।
- বিষয় :
- মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি