ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫

রায় হলেও খুনিরা অধরা

রায় হলেও খুনিরা অধরা

ছবি: ফাইল

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২০ | ২০:৫০

আজ ৩ নভেম্বর, বাঙালি জাতির এক শোকাবহ দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার আড়াই মাসের মাথায় আজকের এই দিনে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। নৃশংস এই ঘটনার ৪৫ বছর পরও এ হত্যাকাণ্ডে করা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ১০ আসামি এখনও পলাতক। তাদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নুর চৌধুরী কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। অন্য আট আসামি কোথায় আছে, সেই তথ্য নেই সরকার গঠিত এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটির কাছে। তবে আশার কথা, চলতি বছরের ১১ এপ্রিল দীর্ঘ অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারীদের অন্যতম এই চার নেতা বেঁচে থাকলে জাতি আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংঘবদ্ধ হবে এমন ভয় থেকেই সেদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী চক্র জেলহত্যার জঘন্য পথ বেছে নেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী খন্দকার মোশতাক তখন রাষ্ট্রপতি। তার প্রত্যক্ষ নির্দেশে ঢাকার তৎকালীন কেন্দ্রীয় কারাগার (বর্তমানে জাদুঘর) কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় একদল সেনাসদস্যের হাতে কারাবন্দি চার নেতাকে তুলে দিতে। কারাকক্ষে তাদের সবাইকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে এই সেনাসদস্যরা। নিহত হন জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান ও প্রথম অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী। এ-সংক্রান্ত মামলাটি বর্তমানে জেলহত্যা মামলা হিসেবে পরিচিত।
এ মামলার পলাতক আসামিদের বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃতুদণ্ড হওয়ায় তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের জন্য ২০১০ সালের ২৮ মার্চ টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়। যার নেতৃত্বে রয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, 'বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জেলহত্যা মামলার আসামির যারা, তারা সবাই একই। ইতোমধ্যে ছয় খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ আমরা কার্যকর করেছি। আরও যারা পলাতক আছেন তাদের খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।'

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা দীর্ঘ ২১ বছর তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে ছিল। অথচ হত্যার পরদিন তৎকালীন ডিআইজি (প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি মামলা করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর কলঙ্কিত এ ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম। এর মধ্যে ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর জেলহত্যা মামলায় ২৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত এ মামলার রায়ে আসামি তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এমএইচএম বি নুর চৌধুরী, এএম রাশেদ চৌধুরী, আবদুল মাজেদ, আহমদ শরিফুল হোসেন, মো. কিসমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনসার, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, একে বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন। রায়ে সাবেক মন্ত্রী কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে খালাস দেওয়া হয়।

পরে আসামিপক্ষে করা আপিলের শুনানি নিয়ে ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অন্য দুই আসামি মারফত আলী ও হাশেম মৃধাকে খালাস দেন। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকেও খালাস দেওয়া হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় দেন। ওই রায়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেওয়া তিনজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়। অবশ্য তার আগে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করে সরকার। তারা হলেন- সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ, একে বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন। তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন ছাড়া অন্য চারজন জেলহত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় গত ১১ এপ্রিল আবদুল মাজেদের ফহ্নাঁসি কার্যকর করা হয়। তিনি জেলহত্যা মামলায় তিনি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। দণ্ডিতদের মধ্যে তিনজন মৃত্যুদণ্ড ও সাতজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে পাঁচজন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়ও দণ্ডপ্রাপ্ত। বর্তমানে পলাতক অন্যান্য আসামি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে বলে সংশ্নিষ্টরা মনে করেন।

খুনিচক্রের বিচার প্রত্যাশা করে জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের সন্তান রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয় শত্রু ও ঘাতকরা বাঙালির রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংসের হীন উদ্দেশ্যেই জাতীয় চার নেতাকে কারাভ্যন্তরে হত্যা করেছিল। এ দিনটি বাঙালি জাতির গভীর বেদনার দিন। তিনি সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন

×