নুনে খুন প্রাণের উপকূল

হাসান হিমালয়, খুলনা ব্যুরো
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২১ | ২১:০৮
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ লবণ। প্রাত্যহিক জীবনে লবণ অপরিহার্য উপাদান, যা খাদ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। লবণ ছাড়া বেশিরভাগ খাদ্যই মুখে রোচে না। প্রতিদিন মানব শরীরের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৩ গ্রাম লবণ। বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ- 'নুন খাই যার গুণ গাই তার'।
অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, সেই রাজার গল্পটি- যার তিন কন্যার একজন রাজাকে বলেছিল, 'বাবা, তোমাকে নুনের মতো ভালোবাসি।' মহাকবি হোমার লবণকে স্বর্গীয় বস্তুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। দার্শনিক প্লেটোর ভাষ্য, লবণ ঈশ্বরের কাছে বিশেষভাবে প্রিয়। জাপানে কোনো মানুষ বা স্থানকে পরিশুদ্ধ করতে হলে লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এত গুণ ও গুণগান যার- সেই লবণ বা নুনই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন চালনা এলাকার গৃহিণী রিনা বিশ্বাস। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ফেরার পথে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, বছরের অর্ধেকটাজুড়েই পেটে সমস্যা থাকে। কথা বলার সময় রিনা বিশ্বাসের হাতে ও পায়ে সাদাটে ঘা দেখা গেল। তিনি জানান, সারাদিন লবণ পানিতে কাজ করায় এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষেরই চামড়া এমন।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কক্ষ থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরছিলেন এক নারী। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোজাম্মেল হক জানান, এর আগে গর্ভকালীন সময়ে এই নারীর ভ্রূণ অকালে নষ্ট হয়ে যায়। এবার ভয়ে ভয়ে আছেন। তাই স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে এসেছেন।
ডা. মোজাম্মেল হক বলেন, লবণ পানির কারণে এই এলাকার মানুষের চর্মরোগ, পেটের পীড়া ও উচ্চ রক্তচাপ কমন সমস্যা। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা গর্ভবতী মায়েদের। এখানকার নারীদের অপরিণত সন্তান প্রসব, ভ্রূণ নষ্ট হওয়া এবং জরায়ু রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার অন্য যে কোনো উপজেলার চেয়ে বেশি।
শুধু দাকোপ বা কয়রা উপজেলায় নয়; দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সমস্যা প্রায় একই। লবণাক্ততার ক্ষত স্থায়ীভাবে চেপে বসেছে এসব এলাকায়। গত কয়েক দশক ধরে এখানকার মাটি ও পানিতে বাড়ছে লবণাক্ততা। লবণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে নারীরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মানুষ ফসলি জমি হারাচ্ছেন, বাঁধ ভেঙে ভেসে যাচ্ছে বাড়িঘর। নতুন ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুও লবণাক্ততার নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাদ যাচ্ছে না।
লবণাক্ততার শুরু ও বৃদ্ধির ধাপ
লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এ অঞ্চলের পরিবেশ ও লবণাক্ততা নিয়ে কাজ করা গবেষক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকাটি মূলত উষ্ণ নোনা ভূমির অঞ্চল। তবে এ অঞ্চলের মাটিতে লবণের মাত্রা ছিল সহনীয়। ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর থেকে এই চিত্র পাল্টাতে থাকে। ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর চিত্র আরও বদলে যায়। আশির দশকে নদীর নোনাপানি কৃষি জমিতে এনে শুরু হয় চিংড়ি চাষ। মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের এক লাখ ৪৫ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে লবণ পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। অর্থাৎ, নদী ও খালের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ জমি এই মুহূর্তে লবণ পানির নিচে রয়েছে।
লবণাক্ততার চিত্র
খুলনার লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ জানতে ১৯৭৩ সালে প্রথম জরিপ চালায় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)। ওই জরিপে দেখা যায়, দেশের উপকূলীয় ১৮টি জেলায় ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ত।
প্রথম জরিপের ২৭ বছর পর ২০০০ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় জরিপ পরিচালনা করে সংস্থাটি। মৃত্তিকা ও পানি লবণাক্ততা জরিপ-২০০০-এ দেখা যায়, লবণাক্ত জমি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ত জমি বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টরে। অর্থাৎ, গত ৩৬ বছরে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ দশমিক ৭ ভাগ। বিদায়ী ২০২০ সালে চতুর্থ জরিপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণের কারণে তা হয়নি।
লবণাক্ততার বর্তমান অবস্থা
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রতি মাসে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৯টি উপজেলার ১৭টি পয়েন্ট থেকে মাটি এবং ১৩টি নদীর পানিতে লবণাক্ততা পরীক্ষা করে। ২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মাটি ও পানির লবণাক্ততা পরিমাপ প্রতিবেদন বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নদীর পানিতে লবণ শুরু হয়, মে মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। অন্যদিকে, মাটিতে লবণাক্ততা সবচেয়ে বেশি থাকে এপ্রিল মাসে।
দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, লবণাক্ততার সহনশীল মাত্রা প্রতি মিটারে পানির জন্য ০.৭৫ ডেসি সিমেন (ডিএস) ও মাটির জন্য ২ ডিএস। মাটিতে লবণক্ততা ৪ ডিএস মিটারের বেশি থাকলে ফলন কমে, ৪ থেকে ৮ ডিএস মিটার পর্যন্ত লবণ থাকলে ফলন আরও কমে যায়। কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। মাটিতে লবণ ১২-এর ওপরে গেলে ফসল আশা করা যায় না। একইভাবে পানিতে লবণাক্ততা ২ ডিএস মিটারের নিচে থাকলে সেচ দেওয়া যায়, ২ থেকে ৪-এর মধ্যে সব ফসলে সেচ দেওয়া যায় না। ৪-এর ওপরে গেলে এই পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা যায় না।
দেখা গেছে, শেষ ১০ বছরে অর্থাৎ, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খুলনার রূপসা নদীতে মে মাসে গড়ে লবণাক্ততা ছিল ১৮ দশমিক ৫৬ ডিএস মিটার। একইভাবে শোলমারী নদীর কৈয়া বাজার পয়েন্টে গড়ে ১৮ দশমিক ৩৭, ডুমুরিয়ার ভদ্রা নদীতে ২১ দশমিক ৯৬, সাতক্ষীরার বেতনা নদীতে গড়ে ২০ দশমিক ৯৮, পাইকগাছার শিবসা নদীতে ২৬ দশমিক ৬৪ ডিএস মিটার।
মাটিতে এই লবণাক্ততা বটিয়াঘাটার কৃষ্ণনগরে এপ্রিল মাসে গড়ে ৬ দশমিক ৪৮ ডিএস মিটার, মোংলা উপজেলার দিগরাজে গড়ে ২০ দশমিক ৭৩, পাইকগাছার শিববাড়ি এলাকার মাটিতে গড়ে ১৩ দশমিক ৯৬ মিটার। অর্থাৎ, শুস্ক মৌসুমে এই অঞ্চলের নদীগুলোর পানি আর ব্যবহার উপযোগী থাকে না।
সম্মিলিত উদ্যোগ কম
লবণাক্ততা উপকূলীয় মানুষ এবং পরিবেশের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে তা মোকাবিলায় সম্মিলিত উদ্যোগ কম। সরকারি সংস্থাগুলো তাদের মতো করে এসব নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লবণসহিষ্ণু জাতের বিভিন্ন সফল উৎপাদন করছে। নদীর লবণ পানি যাতে লোকালয়ে প্রবেশ না করে এজন্য বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (খুলনা-২) পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, দুর্বল বাঁধগুলো মেরামতের জন্য আমরা প্রকল্প পাঠিয়েছি। এ ছাড়া বাঁধ কেটে যাতে নোনাপানি প্রবেশ করাতে না পারে, সেজন্য অভিযান শুরু করেছি। গত সপ্তাহে দাকোপের ৩১ নম্বর পোল্ডারে ১৬টি স্থানে বাঁধ কেটে বসানো পাইপ উচ্ছেদ করা হয়েছে। দাকোপসহ পাইকগাছায় মাইকিং করা হয়েছে। বাঁধ কেটে লবণ পানি ওঠালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরকারিভাবে খাবার পানি নিয়ে কাজ করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। সংস্থাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমান বলেন, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় ৯টি উপজেলার ৫২টি ইউনিয়নকে আমরা বেশি লবণাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছি। এসব জায়গায় আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে পুকুর খনন ও পিএসএফ নির্মাণ এবং যে স্থানে নলকূপে মিষ্টি পানি পাওয়া যায় সেখানে গভীর নলকূপ স্থাপন করি। এ ছাড়া মোংলায় একটি পানি পরিশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
লবণাক্ততা মোকাবিলায় সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগ বা প্রকল্প নেই কেন জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার সমকালকে বলেন, এতদিন সবার মনোভাব ছিল টিআর, কাবিখার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের টাকা সবাইকে ভাগ করে দিতে হবে। কোন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত, কাদের প্রাপ্য এগুলো বিবেচনায় নেওয়া হতো না। জলাবায়ু পরিবর্তন বা লবণাক্ততার কারণে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সবাইকে সেভাবে বোঝানো যায়নি। এজন্য জলবায়ু ট্রাস্টের টাকায় রাস্তা, ড্রেন ও সোলার বাতি নির্মিত হয়েছে। এগুলো বন্ধ করেছি। পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নিয়ে পৃথক কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। লবণের কারণে উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির কষ্ট বেশি। খাবার পানিসহ পরিবেশগত তাদের যেসব ক্ষতি হচ্ছে তা দূর করতে প্রকল্প নেওয়া হবে।