রোহিঙ্গা সংকট
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করাই জরুরি

রাহমান নাসির উদ্দিন
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০
রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা বাংলাদেশে দিন দিন একটা দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল রূপ ধারণ করছে। আজ বড়মাপের রোহিঙ্গার আগমনেরর পাঁচ বছরপূর্তি হলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গাদের বড়মাপের ঢল পাঁচ বছর আগে এলেও ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর পর ১৯৯১-৯২ সালে আসে দ্বিতীয় ঢল। ২০১২ সালে আসে তৃতীয় ঢল। চতুর্থ ঢল আসে ২০১৬ সালে। রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় ঢল নামে ২০১৭ সালে। এ সময়ে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। পুরোনো আর নতুন মিলিয়ে উখিয়া, টেকনাফের ৩৪টি অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ১১ লাখের বেশি। বিগত পাঁচ বছরে সে সংখ্যা ১২ লক্ষাধিক। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এ বিশাল বহরের ভার বহন করছে এবং কতদিন যে তা বহন করতে হবে, সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে পারবে না। ফলে দিন দিন রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। এর বাইরেও নানা বৈশ্বিক বিষয় রোহিঙ্গা সমস্যাকে জটিল করে তুলছে। ২০১৭ সালে যখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনোসাইডের হাত থেকে বাঁচতে লাখো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন গোটা দুনিয়া রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে। দিন দিন আগ্রহের সে উত্তেজনা হ্রাস পেয়েছে এবং সমর্থন ও সহযোগিতাও ক্রমহ্রাসমান। এরই মধ্যে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং তালেবানের ক্ষমতা দখলের কারণে বিশ্বব্যাপী আফগান শরণার্থীদের দিকে বিশ্ববাসী নজর যায়। আবার করোনা মহামারির ভয়াবহতার কারণে ব্যাপক অর্থনৈতিক টানাপোড়েনও বিশ্ববাসীর মনোযোগ রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিজেদের ঘর সামলানোর দিকে দিতে বাধ্য করেছে। তারপরই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এরই মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ ইউক্রেনিয়ান নিজ দেশ ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে ইউক্রেনিয়ান শরণার্থীর দিকেও নজর দিতে হয়েছে। ফলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দরদ ও দায় খানিকটা পাতলা হয়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে বাংলাদেশের যে সংকট; এর মধ্যে তার কোনো কূলকিনারা হলো না। তা ছাড়া রোহিঙ্গারা নিজেরাও ক্রমান্বয়ে হতাশ এবং আশাহীন হয়ে উঠছে। কেননা, একদিকে বাংলাদেশ তাদের বাংলাদেশে আর রাখতে চায় না; অন্যদিকে মিয়ানমারও তাদের ফেরত নিতে চায় না। এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা যাবে কোথায়? এ রকম একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে রোহিঙ্গারাও ক্রমান্বয়ে হতাশ হয়ে পড়ছে। তাই বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বর্তমানে কোথায় এবং কী অবস্থায় আছে, এরও সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর এ মুহূর্তে কারও কাছে নেই।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার শুরু থেকেই এর সমাধানে বাংলাদেশ তাদের প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়েছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে এ অবস্থান সঠিক ও বাস্তবসম্মত। ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে এবং প্রায় দুই মাস ধরে এ ধারা অব্যাহত থাকে। একদিকে মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের কীভাবে দ্রুততম সময়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়, সে প্রক্রিয়াও শুরু করে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বহুপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের প্রতিনিধি নিয়ে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে একটি 'ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট এগ্রিমেন্ট' হয় দুই দেশের মধ্যে এবং তার শর্তানুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরুর দিন থেকে দুই বছরের মধ্যে এ প্রত্যাবাসন শেষ করা হবে। অর্থাৎ দুই বছরের মধ্যে সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত নিয়ে যাওয়া হবে। এ চুক্তির আওতায় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ এবং ২০১৯ সালের আগস্টের ২২ তারিখ, দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু দুটো উদ্যোগই ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতার জন্য প্রধানত দায়ী মিয়ানমার। কেননা, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের কোনো ধরনের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি। প্রত্যাবাসনের পর তারা কোথায় যাবে? কোথায় থাকবে? তাদের ফেলে আসা বসতভিটা কি তারা ফেরত পাবে তাদের জীবনের নিরাপত্তা কে দেবে? তাদের কি নাগরিকত্ব ফেরত দেওয়া হবে? তাদের অনেকের মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজনকে যেভাবে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে; ঘরবাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে; এসবের বিচার হবে কি? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেউ দেয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে আমার যাদের বুঝি, তারা রোহিঙ্গাদের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া দূরে থাক, উল্টো মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি বলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে নিরুৎসাহিত করেছে।
যখন ২০২০ সালের শেষদিকে, বিশেষ করে ডিসেম্বরে করোনা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হচ্ছিল, তখন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন। সু চির 'ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি' এবং মিলিটারি সমর্থিত 'ইউনিয়ন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সলিডারিটি পার্টি'র মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশাপাশি বাড়ছিল দূরত্ব। ফলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা আর শুরু করা যায়নি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ নবনির্বাচিত সরকারকে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করায় পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করার প্রায় দেড় বছর পর ২০২২ সালের ১৪ জুন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের ভার্চুয়ালি একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল সীমিত আকারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে মিয়ানমারের এসব আশ্বাসে আর বিশ্বাস রাখতে পারছে না। কিন্তু জুন মাসে সর্বশেষ ভার্চুয়ালি সভা হলেও এর পর আমরা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত আলোচনা এবং প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি দেখিনি। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করাটা বাংলাদেশের তরফ থেকে একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। ২০১৮ ও '১৯ সালে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি বলে ব্যর্থ হয়েছে বলা হয়। কিন্তু এবার রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। এ বছরেরই জুন মাসে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মিছিল ও সমাবেশ করে 'চলো নিজ বাড়িতে ফিরে যাই, চলো মিয়ানমারে ফিরে যাই' বলে স্লোগান দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ার এই সমষ্টিগত ইচ্ছাকে কাজে লাগাতে হবে এবং বাংলাদেশকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুরু করতে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা, পাড়া-পড়শি ঘুমালেও যার বাচ্চা হুঁশ তারই থাকতে হবে! প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে বড় সংকটে বাংলাদেশ। সুতরাং বাংলাদেশকেই নিতে হবে অগ্রণী ভূমিকা।
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- রোহিঙ্গা সংকট
- রাহমান নাসির উদ্দিন