ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

সমকালীন প্রসঙ্গ

বারবার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে সমাধান কী

বারবার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে সমাধান কী

সবুজ ইউনুস

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১৭:৪৩

ফের বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় হলো। এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার। গত ৬ সেপ্টেম্বর সঞ্চালন ব্যবস্থা বিকল হলে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। মাত্র ২৭ দিনের মাথায় মঙ্গলবার পূর্বাঞ্চলে দুর্ভোগ নেমে এলো। দুপুর থেকে রাত অবধি রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অর্ধেক এলাকা ছিল বিদ্যুৎহীন। অঞ্চলভেদে ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সার্বিক জনজীবন ছিল দুর্বিষহ। বুধবার পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক। তবে দু'একটি এলাকায় রেশ রয়েই গেছে।

বর্তমানে দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎসেবার আওতায়। জাতীয় গ্রিড হলো সর্বোচ্চ শক্তির সঞ্চালন লাইন। ৪০০ কেভি (কিলোভোল্ট) বা ২৩০ কেভি, এমনকি ১৩৩ কেভি লাইনগুলো সঞ্চালন লাইন হিসেবে ধরা হয়। এই সঞ্চালন লাইন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে সরকারি সংস্থা পিজিসিবি-পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ। উচ্চ শক্তির সঞ্চালন লাইন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় কম শক্তির লাইনগুলোতে। অর্থাৎ ৩৩ কেভি ও ১১ কেভিতে। এই কম শক্তির লাইনগুলোকে বিতরণ বা সরবরাহ লাইন বলা হয়। এই বিতরণ লাইন থেকেই বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকদের কাছে সরাসরি বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ফলে জাতীয় গ্রিড বিকল হলে পুরো ব্যবস্থাই অচল হয়ে পড়ে।

পিজিসিবির কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এখনও এই গ্রিড বিপর্যয় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খোলেননি। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার কারণে এতটুকু দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি- আর কেউ না জানুক পিজিসিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অবশ্যই জানেন কী কারণে, কীভাবে, কাদের দায়িত্বহীনতায় এই গ্রিড বিপর্যয় হলো। এ ছাড়া এনএলডিসি-ন্যাশনাল লোড ডেসপাচ সেন্টারের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদেরও কমবেশি বিষয়টি জানার কথা। যান্ত্রিক ত্রুটি হোক আর যা-ই হোক; দ্রুততম সময়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। সারাদেশের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের জানার অধিকার আছে কী কারণে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এ জন্য যে, তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। আশা করি, তদন্তে গ্রিড বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ জানা যাবে। কারও গাফিলতি থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি গ্রিড বিপর্যয় রোধেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য জাতীয় গ্রিড দুটি- পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল। মঙ্গলবার পূর্বাঞ্চল গ্রিড বিকল হয়। মানুষের শরীরে স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালন আকস্মিক বন্ধ হয়ে গেলে যে পরিস্থিতি হয়; বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড বিকল হলে সার্বিক জনজীবনেও তেমন পরিস্থিতি নেমে আসে। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, কল-কারখানায় এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় মঙ্গলবার। নিজস্ব জেনারেটর চালানোর জন্য ডিজেলের চাহিদা বেড়ে যায়। তেল পাওয়া যায়নি বাজারে। দোকানে মুহূর্তে ফুরিয়ে যায় মোমবাতি। পানির জন্য চারদিকে হাহাকার। হাসপাতালের রোগীদের নিদারুণ কষ্ট। টাকা তোলা যাচ্ছিল না এটিএম বুথ থেকে। মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটেও দেখা দেয় সমস্যা।


বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় কমবেশি সব দেশেই হয়। এমনকি উন্নত বিশ্বেও এ নজির আছে। তার যৌক্তিক কারণ থাকে। যেমন বড় মাত্রার ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি। তবে আমাদের মতো এমন ঘন ঘন বিপর্যয় তেমন দেখা যায় না। উন্নত বিশ্বে এ রকম পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দেওয়ার জন্য আধুনিক কারিগরি প্রযুক্তি থাকে। তাদের স্মার্ট বা স্বয়ংক্রিয় জাতীয় গ্রিড। কোথাও কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলেই তা দ্রুত চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। ফলে খুব বেশি সময় তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় না।

প্রশ্ন হলো- কাদের দায়িত্বহীনতার কারণে এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি হলো। পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে নানা তথ্য এলেও দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে কোনো সদুত্তর মিলছে না। তদন্ত কমিটি আগেও হয়েছে বহুবার। তারা প্রতিবেদনও দিয়েছে। সমস্যা সমাধানে সুপারিশ করা হয়েছে। দায়ীদের কমবেশি শনাক্ত করা হয়েছে। দু'একটি ক্ষেত্রে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো সুফল মিলছে না। গ্রিড বিকল থেমে নেই।

গত এক যুগে বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। উৎপাদন ক্ষমতা এখন উদ্বৃত্ত। কিন্তু সরকারের এই সাফল্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো খাতে দুর্বলতার কারণে। এখানে সরকারকে অবশ্যই গভীর মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকার ছিল। সরকার শপথ নেওয়ার পরই বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক গুরুত্বারোপ করে। কিন্তু সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো সম্প্রসারণ এবং আধুনিকায়নে সেই মাত্রায় গুরুত্বারোপ করা হয়নি। ফলে উৎপাদন উদ্বৃত্ত থাকলেও সেই বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। সাশ্রয়ের লক্ষ্য নিয়ে সরকার সময় বেঁধে লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিতরণ অবকাঠামো আধুনিক ও যুগোপযোগী না হওয়ার কারণে তা আশানুরূপ সফল হয়নি।

বিদ্যুৎ এমনই একটি পণ্য, যা মজুত করা যায় না। যখন যতটুকু উৎপাদন হয়, তখন ঠিক ততটুকুই ব্যবহার হয়। উৎপাদন ও বিতরণের মধ্যে এই ভারসাম্য রাখার জন্য সম্পূর্ণ ডিজিটাল ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখনও সম্ভব হয়নি। অনেকটা অ্যানালগ সিস্টেমে এটা চলছে। ন্যাশনাল লোড ডেসপাচ সেন্টার থেকেই সারাদেশের কোন অঞ্চলে কতটুকু বিদ্যুতের চাহিদা, তা নিরূপণ করে সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ কেন্দ্র থেকেই উৎপাদন ও বিতরণের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। এ ভারসাম্যহীনতার কারণেই সাধারণত গ্রিড ফেল করে।

পরিশেষে এতটুকু বলতে চাই, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে সরকার ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখালেও বিতরণ ও সঞ্চালন খাত এখনও অনেক দুর্বল। এখানে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। নতুবা উদ্বৃত্ত বা রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চান। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো খাতে যে দুর্বলতা আছে, তা দ্রুত দূর করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই এখন বিতরণ খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। পুরো সরবরাহ খাত আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল করতে হবে। স্বয়ংক্রিয় গ্রিড বা স্মার্ট গ্রিড করতে হবে। নতুবা সামনে এ রকম বিপদ আরও ঘন ঘন আসতে থাকবে। জনগণ দুর্ভোগের শিকার হবেন; যা কোনোভাবেই কারও কাম্য হতে পারে না।

সবুজ ইউনুস: সমকালের সহযোগী সম্পাদক

আরও পড়ুন

×