এখন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দরকার

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
ওবায়দুল্লাহ রনি
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৪ মে ২০২২ | ০১:৫৫
সমকাল :বাজারে এখন সব জিনিসের দাম বাড়ছে। এ প্রবণতা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ তৈরি করেছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সালেহ উদ্দিন :আমরা এখন বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জে পড়েছি। বৈশ্বিক বিষয়টি হলো- করোনার কারণে ধীর হয়ে পড়া অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধের কারণে দাম বাড়ছে। এতে করে আমদানি খরচ বেড়েছে। আমাদের রপ্তানিও বাড়ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকে ৩৪ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি আছে। তবে রেমিট্যান্স ১৮ শতাংশের মতো কমেছে। যে কারণে বৈদেশিক লেনদেনে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আগেও বাণিজ্য ঘাটতি ছিল। তবে রেমিট্যান্স চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঠিক রাখত। এখন ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। আগে যেখানে ৮ মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ ছিল এখন তা ৬ মাসে নেমেছে। এভাবে রিজার্ভ কমা আমাদের জন্য চিন্তার ব্যাপার। জোগান কম থাকায় এর মধ্যে ডলারের দরও বেড়েছে। আবার ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দরে অনেক পার্থক্য তৈরি হয়েছে। সাধারণত এত পার্থক্য থাকে না। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে ডলারের দরের চাহিদা বেড়ে গেলে তখন এমন পার্থক্য তৈরি হয়।
সমকাল :এ সময়ে আমাদের করণীয় কী?
সালেহ উদ্দিন :বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এভাবে দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে হবে। প্রথমত, আমদানি যৌক্তিকীকরণের চেষ্টা করতে হবে। এই যে অনেক যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আসছে। এমনকি বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় এমন ভোগ্যপণ্যও আনা হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এখন করছে। এটাও দেরি হয়ে গেছে। এলসি মার্জিন বাড়ানোয় হয়তো কিছু সুফল আসবে। তবে ব্যাংকগুলো এলসি মার্জিনের নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালন করছে কিনা তদারকি করতে হবে। যে আমদানি দেখানো হচ্ছে তা যথাযথ কিনা যাচাই করতে হবে। আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং তথা পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা তদারক করতে হবে। যে পরিমাণ জিনিস আসার কথা, তা প্রকৃতপক্ষে আসছে কিনা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও কাস্টমসকে তদারক করতে হবে। ব্যাংকগুলোতেও ব্যাপক ভিত্তিতে পরিদর্শন করা যেতে পারে। অনেক সময় তো খালি কনটেইনার আসে। আবার যেসব যন্ত্রপাতি আমদানি দেখানো হচ্ছে, আসলে তা স্থাপন করা হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। এসব পদক্ষেপ নিতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কিছুটা কমবে। সময়মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কার কী অবস্থা হয়েছে সবার জানা।
সমকাল :মূল্যস্ম্ফীতি এবং মানুষের আয় বেড়ে যাওয়ার সরকারি পরিসংখ্যানকে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করেন?
সালেহ উদ্দিন :সরকারি হিসাবে বাজারের প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন স্বচ্ছতার সঙ্গে রাখতে হবে। সরকার যে আনুষ্ঠানিক মূল্যস্ম্ফীতি দেখাচ্ছে সেখানে প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন হয় না। পরিবহন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, সেবাসহ সব খরচ বেড়েছে। অথচ আয় সেভাবে বাড়েনি। এরপরও দেশের মাথাপিছু আয় নাকি ২ হাজার ৮২৪ ডলার হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে এটা কতটুকু বেড়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একটি পক্ষের আয় হয়তো বেড়েছে। যাদের আয় বেড়েছে খাদ্যে তাদের খরচ খুব কম। যে কারণে এসব হিসাব নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের ওপর প্রকৃত প্রতিফলন পড়ে না। বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে ভোজ্যতেলের কথা বলা যায়। দেখা যাচ্ছে, জিনিস আছে অথচ সরবরাহ হয়নি। এখন অবৈধভাবে মজুত করা প্রচুর ভোজ্যতেল উদ্ধার করা হচ্ছে। এদের জরিমানা করা কোনো সমাধান নয়। এটা আমাদের সুশাসন ও তদারকির ব্যর্থতা। দক্ষতার সঙ্গে এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাকে সহজ করতে হবে। কোনো সিন্ডিকেট বা ম্যানুপুলেশন থাকবে না। কৃষিসহ যে কোনো পণ্য উৎপাদনকারীকে যথাযথ মূল্য দিতে হবে।
সমকাল :জিনিসের দাম বাড়ার চাপ দরিদ্র মানুষের ওপর বেশি পড়ছে। তাদের জন্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করতে পারে?
সালেহ উদ্দিন :খাদ্যদ্রব্যের সরকারি মজুত ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। সরকারের হাতে প্রচুর মজুত থাকলে মজুতকারীরা ভয় পায়। বিশেষ করে চাল, গম, ডাল এ ধরনের পণ্যের মজুত বাড়াতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো আগাম ধারণার ভিত্তিতে চাল, ডাল, গম, তেল এ ধরনের পণ্য আমদানি করতে হবে। ব্যবসায়ীরা যেন সুযোগ নিতে না পারে তা খেয়াল রাখতে হবে। বাজার তদারকি করতে হবে। তাতে দর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। জরিমানা করা কোনো সমাধান নয়। বরং জেল দিতে হবে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। যে ব্যক্তি ৮০ হাজার লিটার তেল রাখল তাকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করে কী লাভ? এ ছাড়া মুদ্রানীতিকে ইচ্ছামতো সম্প্রসারণমূলক করা ঠিক হবে না। এখন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিতে হবে। কেননা ঋণ বাড়লেও তো বড়রাই পাবে। প্রণোদনা প্যাকেজসহ বিভিন্নভাবে বড়রা অনেক টাকা নিয়েছে। ছোটরা তো পায়নি। এ ছাড়া ঋণ কোথায় দেবে, মুদ্রানীতিতে বিশদভাবে তা উল্লেখ করতে হবে।
সমকাল :অনেকেই ডলারের দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিচ্ছেন। আপনার পরামর্শ কী?
সালেহ উদ্দিন :ডলারের দর বাড়ালে রপ্তানিকারকরা সুবিধা পাবেন। তবে আমদানি ব্যয় বেড়ে মূল্যস্ম্ফীতির ওপর আরও চাপ তৈরি হবে। টাকার দর হয়তো আরও ৫ বা ১০ শতাংশ অবমূল্যায়ন করা হলো। একই হারে যদি রপ্তানি না বাড়ে তাতে লাভ কী? রপ্তানিকারকের হয়তো আয় বাড়বে, তবে সাধারণ মানুষ তো আর উপকৃত হবে না। ফলে ডলারের দর আরও বাড়ানো কোনো সমাধান নয়। এ ছাড়া রপ্তানি শুধু তৈরি পোশাকে সীমাবদ্ধ না থেকে পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। বাজেটে পোশাক খাতে বেশি প্রণোদনা দেওয়া হয়। অভ্যন্তরীণ শিল্পকে উৎসাহিত করতে হবে। তাতে আমদানি কমে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে। আবার অভ্যন্তরীণ বাজারে কর্মসংস্থান হবে। তাতে দুই দিকেই লাভ হবে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওবায়দুল্লাহ রনি