ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

'বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম'

'বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম'

প্রতিকৃতি :তন্ময় শেখ

--

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০

মোখলেছুর রহমান। গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলায়। চার দশক আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ঢাকায়। জীবনের তাগিদে কখনও রিকশা চালিয়েছেন। কুলির কাজ করেছেন। এখন অটোরিকশা চালান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে লিখছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন
অটোরিকশা চালক হলেন কীভাবে?
মা-বাবার সঙ্গে রাগ করে ঢাকায় চলে আসি। সঙ্গে টাকা-পয়সা ছিল না। পেটে ক্ষুধা, কাজ না করলে তো ভাত জুটবে না। হোটেলে হোটেলে থালা-বাসন পরিস্কার করেছি। তারপর সেখান থেকে ঠেলাগাড়ি চালাই। বাসের হেলপার করি। রিকশাও চালিয়েছি। মেসে আমার রুমে সিএনজিচালিত এক অটোরিকশা চালক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি একদিন তাঁকে অটোরিকশা চালানো শেখাতে অনুরোধ করি। তিনি রাজি হন। কোনো টাকা ছাড়া, ধীরে ধীরে আমি অটোরিকশা চালানো শিখে যাই। সেই থেকে শুরু হয় এই নতুন কাজ।
পালিয়ে আসার কতদিন পর বাড়ি ফিরলেন?
বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পর সবাই আমাকে অনেক খুঁজেছেন। কিন্তু কেউ কোথাও পাননি। একদিন কাজ করতে করতে মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। চোখে পানি এসে গেছে। পরে আর কোনো কিছু ভালো লাগে না। তাই ভাবলাম বাড়ি যাওয়া দরকার। প্রায় এক বছর পর বাড়ি ফিরি। সেই দৃশ্য এখনও চোখের সামনে ভাসে। আমাকে দেখে মা জড়িয়ে ধরেন। বাবা এসে হাউমাউ করে কাঁদেন। আসলে অভাবের তাড়নায় বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। ঠিকমতো খাওয়া জুটত না। পরে আমার মা-বাবা বলেন, 'আমাদের কথা দে, কোনো খানে গেলে বলে যাবি। এভাবে আর পালিয়ে কোথাও যাবি না।' মা-বাবার পা ধরে মাফ চেয়েছি। আমিও হাউমাউ করে কান্না করি। এভাবে কিছুদিন থাকি। পরে মা-বাবাকে বুঝিয়ে আবার ঢাকায় চলে আসি।
আপনার পরিবাবের কে কে আছেন?
বিয়ে করেছি আমাদের এলাকাতেই, মা-বাবার পছন্দে। আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এক ছেলে মাস্টার্স পাস, চাকরি হয়নি, চেষ্টা করছে। আরেক ছেলে কলেজে পড়ে।
যে আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালাতে পারেন?
এখন ভালোই চলে। প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট হতো। টাকা জমাতে পারিনি; বরং খাওয়ার টাকাও থাকত না। কিন্তু পরে টাকা জমাতে শিখে যাই। সন্তানদের মানুষ করতে থাকি। ঘর পালানো মানুষটা পরিবারের অভিভাবক হয়ে উঠি। তবে এই কাজে একটু ঝুঁকি আছে।
কোন ধরনের ঝুঁকি?
রাস্তায় চলা মানেই এক ধরনের ঝুঁকি। ভয় থাকে কখন কোন দিক থেকে অন্য গাড়ি এসে আমাকে মেরে দেয়। দুর্ঘটনা হয়। আমার কোনো কিছু হলে তো পরিবারকে পথে বসতে হবে।
আপনার এই দীর্ঘ জীবনে তো অনেক ঘটনা দেখেছেন। মনে রাখার মতো একটি ঘটনা বলুন?
একটা সময় ছিনতাইকারী বেশি ছিল। তাদের অত্যাচারে রাস্তা-ঘাটে চলাচল অনেক কষ্ট হতো। তখন বেবিট্যাক্সি চালাতাম। একবার এয়ারপোর্ট এলাকায় দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম পাশে তিনজন ছুরি নিয়ে এদিক-সেদিক দেখছে। আমার দিকে আসার পরিকল্পনা করছে। আমি বুদ্ধি করে অন্যদিকে চলে যাই। গাড়ি লক করে চাবি নিয়ে দূরে চলে যাই। পরে তারা বিরক্ত হয়ে চলে যায়। তারপর মন থেকে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। তা ছাড়া আরও অনেক ঘটনা দেখেছি। যাত্রী বেশে পান খেতে বলেছে। একবার তো আমাকে পান খাওয়ার জন্য খুব জোর করেছে কিন্তু আমি এড়িয়ে গেছি। আবার কলা খেতে বলেছে। তারপর সেভেন আপ খেতে বলেছে। কিন্তু আমি এগুলো কৌশলে এড়িয়ে গেছি।
জীবনের এই সময়ে এসে কেমন লাগে?
আবার আগের জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। চোখের সামনে কত কী দেখলাম! নিজের কত পরিবর্তন। তবে যতদিন সুস্থ থাকতে পারি, ততদিন যেন অটোরিকশা চালিয়ে যেতে পারি।

আরও পড়ুন

×