সাক্ষাৎকার
১৫ বছর পর গ্রীষ্মকালে ঘরের বাইরে গেলেই মানুষের মৃত্যু হতে পারে
জি এম মোস্তাফিজুল আলম
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৪ | ১৪:১৪ | আপডেট: ০৬ মে ২০২৪ | ১৮:১১
জি এম মোস্তাফিজুল আলম চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। তিনি পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে সংবাদ করেন এবং এসব বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন বিভাগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০১৫’ জয় তাঁর কাজের স্বীকৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন কভার করেছেন তিনি। দেশের চলমান তাপপ্রবাহ, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভবিষ্যৎ সংকট নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সমকালের নিজস্ব প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত।
সমকাল: দেশে ৭৬ বছরের রেকর্ড ভাঙা তাপপ্রবাহ চলছে। আবহাওয়ার এই বিরূপ আচরণের কারণ কি?
জি এম মোস্তাফিজুল আলম: এটা মূলত বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে হচ্ছে। আপনি জানেন, বিশ্বব্যাপী শিল্প-কারখানা ও পরিবহন খাতে জীবাশ্ম জ্বালানীর অতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও কৃষি সম্প্রসারণের ফলে বায়ুমণ্ডলে অধিক হারে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। অন্যদিকে বন উজার হয়েছে নির্বিচারে। ফলে অতিরিক্ত কার্বন বায়ুমণ্ডলে জমা হয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রাক-শিল্পযুগের (১৮৫০-১৯০০) তুলনায় এখন পর্যন্ত পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৫ থেকে ২০২৩, টানা এই ৯টি বছর ছিল ইতিহাসের উষ্ণতম বছর। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, তাপ প্রবাহ, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাবে। হয়েছেও তাই, গত ৫০ বছরে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণ। আবার যেসব সামুদ্রিক মহাদুর্যোগ শত বছরে একবার হতো, তা প্রায় প্রতি বছরই সংঘটিত হবে। বাংলাদেশের এই রেকর্ড তাপপ্রবাহের পেছনেও আছে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব। কারণ, তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে বায়ুপ্রবাহ, বায়ুর চাপ, তাপ ও আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি বায়ুমণ্ডলীয় প্রক্রিয়ায় তারতম্য ঘটে।
সমকাল: পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমরা এর জন্য কতটা দায়ী?
জি এম মোস্তাফিজুল আলম: আপনি জানেন, ২০২৩ সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ হয়েছে ৩৬ বিলিয়ন মেট্রিক টন। অথচ ২৫ বছর আগেও বছরে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ছিল কমবেশি ২০ বিলিয়ন মেট্রিক টন। আর এই কার্বন নিঃসরণের কারণেই অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এই বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র ০.৫৬ ভাগ করে থাকে বাংলাদেশ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে সপ্তম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে এবং বরফ গলা পানিতে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বর্তমানে বৈশ্বিক সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার বছরে ৪.৫ মিলিমিটার। ক্লাইমেট রিয়ালিটি প্রজেক্টের তথ্য বলছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বাড়লে ১১ শতাংশ জমি হারাবে বাংলাদেশ। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ভিটে ছাড়তে বাধ্য হবেন।
সমকাল: প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আওতায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২১০০ সাল নাগাদ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে, সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে রাখার জন্য একমত হয়েছে সব দেশ। তার জন্য যা করতে হবে তার কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে?
জি এম মোস্তাফিজুল আলম: প্যারিস জলবায়ু চুক্তি তথা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ‘নেট জিরো’ বা ভারসাম্য অবস্থায় যেতে হবে। দূষণকারী ধনী দেশগুলো অর্থনৈতিক ক্ষতির আশংকায় তা করতে চাইছে না। বিশ্বের সব দেশ মিলে এখন পর্যন্ত যতটা কার্বন নিঃসরণ কমাবে বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে তাপমাত্র বৃদ্ধি তো কমবেই না, বরং ২১০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্র প্রাক-শিল্পযুগের (১৮৫০-১৯০০) তুলনায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি বৃদ্ধি পাবে। যা হবে পৃথিবীর জন্য মহাবিপর্যয়কর।
সমকাল: তাহলে আগামী দিনগুলো কি আরও বিপর্যয়কর হবে?
জি এম মোস্তাফিজুল আলম: বিজ্ঞানীরা এতদিন যে পূর্বাভাস দিয়ে আসছিলেন তাতে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ১৫ থেকে ২০ বছর পর হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো এখনই হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আগামী দিনগুলো খুবই কঠিন হবে যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়। আইপিসিসি'র সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৪০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগের (১৮৫০-১৯০০) তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ, ১৫ বছর পর পৃথিবীর অনেক জায়গায় গ্রীষ্মকালে ঘরের বাইরে গেলেই গরমে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের অবস্থা হবে আরও বিপর্যকর।
সমকাল: তাহলে আমাদের করণীয় কি?
জি এম মোস্তাফিজুল আলম: প্রথমত, দেশের সম্ভাব্য সব জায়গায় গাছ লাগাতে হবে, বন ও জলাশয় রক্ষা বা পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পরিবর্তিত আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তৃতীয়ত, দূষণকারী দেশগুলো যাতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে বাধ্য হয় সে লক্ষ্যে জনমত তৈরি করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে বাংলাদেশকে উচ্চকণ্ঠ হতে হবে।