সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম
ফ্যাসিস্ট কাঠামো বিলোপ হয়তো দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থানের প্রয়োজন হবে
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। ছবি: সমকাল
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪ | ২২:১৭ | আপডেট: ২০ আগস্ট ২০২৪ | ০২:২২
অন্তর্বর্তী সরকার এখন কী করছে ও কী করবে, আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ এবং নিজের রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক ফারুক ওয়াসিফ।
সমকাল: আপনি রাজপথের নেতৃত্ব থেকে এখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে। আগের এবং বর্তমান ভূমিকার সমন্বয়ে কোনো সমস্যা বোধ করছেন কি না?
নাহিদ : এটা আমার জন্য একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা মারাত্মক সব ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়ে এসেছি। পরিস্থিতিই এমন ছিল যে, যেহেতু নতুন সরকার হচ্ছে সেহেতু আমাদের এখানে থাকা প্রয়োজন। এটা সরকারের প্রতি আস্থা, বৈধতা, গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করবে।
সমকাল: কিন্তু পুরোনো প্রশাসনে নতুন ডিরেকশন কাজ করবে?
নাহিদ: কিছুটা তো অসুবিধা আছেই। পুরো কাঠামোটাই আগের। আমরা তো রাজনৈতিক দল নই। রাজনৈতিক দল হলে তার সেটআপ আগে থেকেই তৈরি থাকে। আমরা যে ধরনের নিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক মানুষ চাইছি, সে ধরনের মানুষ খুঁজে বের করা এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতেও সময় লাগছে। আবার যারা রাজপথে আছেন তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। প্রথম থেকেই আমাদের কথা ছিল রাজপথেও আমাদের শক্তি থাকবে, আবার সরকারের ভেতরেও থাকবে।
সমকাল: আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন, সংস্কার করবেন, তা মানুষ জানতে চায়। যেমন আর কখনোই যাতে ইন্টারনেট বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তার জন্য আপনারা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন?
নাহিদ: যেমন এনটিএমসি সংস্থা বা নজরদারি বন্ধের কথা আসছে। সামগ্রিকভাবে আমরা কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে কাজ করছি যাতে দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসে। যেমন তথ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল সিকিউরিটি বিষয়ক আইনগুলো নিয়ে আমরা কাজ করবো।
সমকাল: সিএসএ/ডিএসএ আইন দিয়ে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। বিজ্ঞাপন বন্ধ, বিভিন্ন সংস্থা থেকে ফোন করে ভয় দেখানোও ছিল। আবার গণমাধ্যমের মধ্যেও সেলফ সেন্সরশিপ ছিল যা স্বৈরাচারকে সাহায্য করেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি দুটোই তো নিশ্চিত হওয়া দরকার?
নাহিদ: আমরা গণমাধ্যমের জন্য স্বাধীন কমিশনের কথা ভাবছি। যেন সরকারের কাছে দায়বদ্ধ না থেকে কমিশনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের সমস্যা সমাধান করা যায়। আমরা গণমাধ্যমের সঙ্গে বসতে চাই, তাদেরও নিশ্চয়ই প্রস্তাবনা আছে। সেগুলো আমলে নিয়ে আমরা পদক্ষেপ নেব।
সমকাল: সরকার গঠনের পরে ১০ দিনের বেশি হয়ে গেল। গণহত্যার বিচার, অন্তর্বর্তী সরকারের রোডম্যাপ, দুর্নীতি বিষয়ে মানুষ শক্ত পদক্ষেপ চায়। অথচ এখনও পর্যন্ত এসব বিষয়ে আপনারা স্পষ্ট পদক্ষেপ নেননি?
নাহিদ: আমরা একটা বিষয়ে সচেতন থাকছি, ক্ষমতাকে ব্যবহার করে জবরদস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা যেন আমরা না নেই। আমরা প্রক্রিয়াগতভাবে স্বচ্ছ ও সঠিক থাকি, যাতে পরে এসব নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে। সেজন্য আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগোতে চাইছি। প্রশাসনের সব জায়গায় অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। কর্মকর্তাদের তালিকা করা হচ্ছে, তাদের অতীত ভূমিকা দেখা হচ্ছে, তাদের সম্পত্তির হিসাব যাচাই করা হচ্ছে। অভিযোগ এলে আমরা প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেব। প্রশাসনের রদবদল বিষয়েও আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমার মন্ত্রণালয়েও কর্মকর্তাদের কার্যক্রম এবং সম্পদের পরিমাণ বিষয়ে তদন্ত করছি। গণহত্যা বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, জাতিসংঘের একটা দলও আসছে। অভিযুক্তদের মানবাধিকারও যেন লঙ্ঘিত না হয়, সে বিষয়েও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। দ্রুত সময়ের মধ্যেই উদ্যোগগুলো মানুষের কাছে স্পষ্ট করা হবে। এটা তো এক দিনের বিষয় না। ১৫ বছরের দুর্নীতি-অনিয়ম-বিপর্যয়। পুরো ব্যবস্থাটিই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে আছে। কাজগুলো মুখের হুকুমে দ্রুত করা সম্ভব, পলক সাহেব করেছেন। তিনি মৌখিক নির্দেশেই আন্দোলনের সময়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরা তেমন করতে চাই না। আমরা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চাই।
সমকাল: বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমে মনগড়া খবর প্রচার করা হচ্ছে। দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্যও এটা ক্ষতিকর। বাংলাদেশের জন্যও ক্ষতিকর। এ ব্যাপারে আপনারা কী করছেন?
নাহিদ: পররাষ্ট্র দপ্তর বিষয়ক বৈঠকে বিষয়টা আলোচিত হয়েছে। আমি নিজেও একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রধান উপদেষ্টা একদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছেও খোলা ডাক দিয়েছেন যে, আপনারা সরেজমিনে জেনে যান যে মাইনরিটির পরিস্থিতি কী।
সমকাল: গণমাধ্যমের মালিকানায় দুর্বৃত্তরাও কেউ কেউ বসে আছেন। আবার কালো টাকা সাদা করাসহ নানা অসাধু কাজে গণমাধ্যম ব্যবহৃত হয়েছে। এটা ঠেকানোয় আপনাদের কোনো উদ্যোগ আছে কি না?
নাহিদ: দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তো আলাদা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবেই। আমরা সার্বিকভাবে গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা চাচ্ছি। গণমাধ্যমের কাছেও আহ্বান থাকবেন যে, তাদের জায়গা থেকেও যেন সচেতনতা আসে। গণমাধ্যমেও কিন্তু দলীয়করণ আছে, সাংবাদিক সংগঠনগুলোও দলীয়ভাবে বিভক্ত। গণমাধ্যমের কাছ থেকেও অভিযোগ ও সুপারিশ পেলে আমাদের জন্যও কাজ করায় সুবিধা হবে।
সমকাল: আপনারা এখনই রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা করছেন না। তাহলে আন্দোলন ও জমায়েত ধরে রাখায় আপনাদের পরিকল্পনা কী?
নাহিদ: তার জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার কথা আমরা ভাবছি। জাতীয়ভাবে একটি নাগরিক সংগঠনের কথা ভাবছি। যারা আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং যারা অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ধারণ করেন, তাদের নিয়ে এই প্ল্যাটফরম হবে। এসবের মাধ্যমে আমরা মাঠের জমায়েতকে ধরে রাখতে চাইবো।
সমকাল: বিগত সরকার এমন অনেক চুক্তি করেছে, যা সংসদে আলোচিত হয়নি, কখনো প্রকাশ্যে আসেনি। জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই চুক্তিগুলো জনগণের সামনে প্রকাশের দাবি উঠেছে?
নাহিদ: বিগত সরকারের গোপন ও প্রকাশ্য সব ধরনের চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের চিন্তা আমাদের রয়েছে। যে চুক্তিগুলোতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি, সেসব অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আর তথ্যের যে অধিকার তা মৌলিক অধিকার। আমরা এসব অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মানুষের জানার অধিকারের প্রতি আমাদের দায় রয়েছে। নিতান্তই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় ছাড়া আমাদের সব বিষয়ই উন্মুক্ত থাকবে।
সমকাল: আন্দোলনের নেতা ও সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের সামনে প্রধান বাধা কী?
নাহিদ: আমরা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার পুরোপুরি বিলোপ করতে পারিনি, সেই কাঠামো এখনও রয়ে গেছে। সেটা বিলোপ করার জন্য আমাদের হয়তো একটা দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হবে। বিগত সরকার লুটপাট দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে দেশকে ছোবড়া করে দিয়েছে, বিশেষ করে অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। এগুলো আবার দাঁড় করানো, সিস্টেমকে চালু করা আমাদের কাজ। দেখুন, আগে দেশ চলেছে এক ব্যক্তির জন্য এক ব্যক্তির নির্দেশে, এক ব্যক্তিকে ঘিরে। এমনকি এখনও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের কাছে মানুষ দাবি-দাওয়া নিয়ে যাচ্ছে। তার মানে সেই একই মনস্তত্ত্ব রয়ে গেছে যে, একজন ব্যক্তিই সব সমাধান দিয়ে দেবে, তার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই হবে। এটা একটা সমস্যা। তো, একটা কাঠামো যদি আমরা তৈরি করতে না পারি, সমস্যাগুলো তো সমাধান করা যাবে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ যে, আগের কাঠামো বিলোপ করে নতুন কাঠামো তৈরি করা। অর্থনীতিতে গতি নিয়ে আসা। নতুন জেনারেশনের মনে নতুন আদর্শ নতুন ভিশন নতুন স্বপ্ন জাগিয়ে দেওয়ার কাজ এখনও বাকি।
সমকাল: বাংলাদেশে পাল্টাপাল্টি দুই জাতীয়তাবাদ রয়েছে। এর বাইরে ডান ও বাম মতাদর্শ রয়েছে। আপনারা কী ধরনের আদর্শের কথা ভাবছেন। কোন রূপরেখা?
নাহিদ: আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কিছু নীতি ও এথিকস উঠে এসেছে। আমরা ন্যায়বিচার বা জাস্টিসের কথা বলেছি, রেসপন্সিবিলিটির কথা বলেছি, মানবাধিকারের কথা বলেছি। এখন এসবের একটা রূপ দেওয়াটাই কাজ। বাংলাদেশের মানুষের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, তার কথা বলছি। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, জাতীয়তাবাদের যুগ শেষ হয়ে আসছে। আমাদের জাতীয়তাবাদের নানা ধরনের সমালোচনা ও দুর্বলতা আছে। আমাদের একটা জাতীয় চরিত্র নির্মাণ করতে হবে। সংস্কৃতি বনাম ধর্মের বানোয়াট বিরোধ ভেঙে ফেলতে হবে। সমাজের সব মানুষের সব উপাদান নিয়ে জাতীয় চরিত্র নির্মাণ করতে হবে। এতদিন আমাদের ইতিহাসকে ৫২ থেকে ৭১ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এই দেশের আরও বড় যে ইতিহাস রয়েছে, সেসবের নির্মোহ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। গোটা পৃথিবীই এখন সভ্যতাগত রাজনীতির দিকে আগাচ্ছে। ভারত ও চীনও কিন্তু সভ্যতাগত পরিচয় ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পৃথিবীর বুকে দাঁড়াচ্ছে। সেই জায়গা থেকে আমাদেরও সভ্যতাগত পরিচয় অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
সমকাল: আপনাদের ঘিরে এক ধরনের জাতীয় ঐক্য আছে। এটা টিকিয়ে রাখতে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামসহ যেসব বাম ও ডানপন্থি গণতান্ত্রিক দল রয়েছে, যারা বিগত সরকারের বিরোধী ছিল, তাদের নিয়ে বড় কোনো জোট গঠনের কথা কী ভাবছেন?
নাহিদ: জাতীয় ঐক্যের বিষয়টাতেই আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। রাজনৈতিক দল গঠনের আলাপ এ জন্য এড়িয়ে যাচ্ছি। কারণ এই সময়ে রাজনৈতিক দলের চিন্তা করি বা কার্যক্রম শুরু করি, তাহলে আমরা এক ধরনের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে চলে যাব। একদম অহেতুক প্রতিযোগিতা হবে। যে জাতীয় ঐক্য আমাদের মাঝে তৈরি হয়েছে, সেটাকে আমরা রক্ষা করতে চাই। সবগুলো দলের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত আলাপ আলোচনা চলছে। বিভিন্ন ধরনের পেশাজীবী ও নাগরিকদের জায়গাকেই আমরা দলের থেকেও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ নাগরিক সমাজই আমাদের এই আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ঐক্য ধরে রাখার জন্যই আমরা নাগরিক সংগঠনের কথা ভাবছি।
সমকাল: আপনাদের আন্দোলনে ছাত্রদের পরে কিন্তু সবচেয়ে বেশি এসেছিল শ্রমজীবী মানুষ। এখন তো তাদের পাশে সরকারকে সবসময় পাওয়া যাচ্ছে না। শহীদ এবং আহত, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে থাকার জন্য আপনারা কোনো টাস্কফোর্স গঠন করছেন কি না। কোনো তহবিল বরাদ্দ হবে কি না:
নাহিদ: একটা ফাউন্ডেশন তৈরির কথা হয়েছে। এটা সম্ভবত আজ বা কালকে ঘোষণা করা হবে। নামটা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন বা এমন কিছু হবে। নামটা এখনই জানাচ্ছি না। ড. ইউনূস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান থাকবেন এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা থাকবেন। এই ফাউন্ডেশন মূলত দেশে এবং বিদেশে চিকিৎসা ও সেবার জন্য তহবিল গঠন করবে এবং শহীদ ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তাসহ দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ চালাবে। তাদের স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখার জন্য এই ফাউন্ডেশনটা কাজ করবে।
সমকাল: একেবারে শেষ প্রশ্ন- আপনাদের আন্দোলন বিভিন্ন সময় পার করেছেন ভয়াবহ সব ঘটনা। তো এর ভেতরে কয়েকটা বা দুই-তিনটা মুহূর্তের কথা বলেন, যা আপনি কোনোদিন ভুলবেন না বা যা আপনাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে?
নাহিদ: আন্দোলনটা যখন আমরা শুরু করি তখন কিন্তু আমরা তেমন সাড়া পাইনি। কারণ ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের শেষ পরিণতিটা তত ভালো না। আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজও প্রাথমিকভাবে আমাদের এই আন্দোলনকে তেমন গুরুত্ব দেননি। কেউ কেউ বলেছেন, এটা সরকারেরই এক ধরনের ইস্যু তৈরির চেষ্টা আরকি। কিন্তু আমরা আমাদের জায়গা থেকে দেখেছিলাম যে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের প্রতি খুবই কমিটেড। কোটা সংস্কার আন্দোলন একেবারে তাদের নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িত। এই আন্দোলনের আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীরা কিন্তু ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। তারাই কিন্তু একটা পর্যায়ে এই আন্দোলনকে টেনে নিয়ে গেছে। প্রতিদিনই মেয়েরা আসতো। চেহারা দেখতে দেখতে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। তারা প্রতিদিন আসছে এবং সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে থাকছে। আমার কাছে মনে হয় যে শুরুতে একটা ভয় ছিল সবার ভেতরে। আস্তে আস্তে যখন ভয়টা ভাঙা শুরু করছে তখন এটা সবাইকে প্রভাবিত করেছে। আর আবু সাঈদের মৃত্যু অবশ্যই, বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে যে সাহসটা করছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অভূতপূর্বভাবে যে সাড়া দিয়েছে— এসবই আন্দোলনের মুহূর্ত। এই আন্দোলন স্টুডেন্ট সলিডারিটি এবং একইসঙ্গে পিপলস সলিডারিটি। আন্দোলন কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়। তারপর যেই হল ভ্যাকান্ট করা হলো, আমরা কিছুটা ব্যাকফুটে, তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেল। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যখন ব্যাকফুটে তখন কিন্তু শ্রমিক-পেশাজীবী অন্যান্যরা এগিয়ে এসেছে। যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের মেয়েদের ওপর হামলা হয়, ওটা একটা বাজে মুহূর্ত আমাদের কাছে। কারণ আমরা আমাদের বোনদের রক্ষা করতে পারিনি। ৩ আগস্ট আমার কাছে খুব স্মরণীয় একটা দিন ছিল। কারণ ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে তো আমি আসলে রাজপথে ছিলাম না। আমাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, তারপর হাসপাতালে, তারপর ডিবি অফিসে। তো ৩ আগস্ট আমি প্রথমবারের মতো আবারও রাজপথে এসেছিলাম। খুবই অসুস্থ অবস্থায় এসে এক দফার ঘোষণাটা আমরা দিতে পেরেছিলাম। ওইটা আমার জন্য খুবই স্মরণীয় একটা মুহূর্ত ছিল। আমার ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না আসলে। কেউ একজন ঘোষণায় আসার দরকার ছিল। ঘোষণার আগেই মানুষজনের মধ্যে দাবিটা তৈরি হয়েই ছিল। তো আমি এসে জিনিসটাকে জাস্ট একনলেজ (স্বীকার) করেছি। এই মুহূর্তগুলো খুবই স্পেশাল ছিল। স্টুডেন্ট সলিডারিটিটা আমার কাছে খুবই.. যে আমরা কেউ কাউকে চিনি না জানি না কিন্তু একসঙ্গে আন্দোলন করছি। আর ওই যে সহযোগিতা— ঢাকায় আন্দোলনটা ব্যাকফুটে গেলে হয়তো চট্টগ্রাম বা কুমিল্লায় উঠে দাঁড়াচ্ছে। আবার ঢাকায় শেষের দিকে স্পেস দিচ্ছিল কিন্তু বাইরে প্রচুর শহীদ এবং আহত হয়েছে। ৪ আগস্ট ঢাকার বাইরে প্রচুর হতাহত হয়েছে। অভিভাবকরা বিভিন্ন পেশাজীবীরা যেভাবে সহযোগিতা করেছে। এই পুরো সময় আমি একেক সময় একেক রাত একেক জায়গায় ছিলাম। যার বাসায় গিয়েছি সেইই সাপোর্ট দিয়েছে। আমার মনে আছে ৪ আগস্ট আমি আমার এক শিক্ষকের বাসায় ছিলাম আমার কাছে পোশাকও ছিল না। স্যারের শার্ট পরে আমি ৫ আগস্ট চলে আসছি। এ রকম অনেক স্মৃতি আছে হয়তো পরে একসময় বলা যাবে।
সমকাল: আপনি নিজেকে ৫ বছর পর বা ১০ বছর পর কোন ভূমিকায় দেখতে চান?
নাহিদ: আমরা একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে একটা জায়গায় এসেছি। এখানে আমার ব্যক্তিসত্তার জায়গাটা খুবই কম। আমি কোনো ব্যক্তিগত জায়গা থেকে এখানে আসিনি। আমি জনগণের প্রতিনিধিত্বের জায়গা থেকে প্রশাসনের জায়গায় এসেছি। আমাদের আন্দোলনে অজস্র মানুষ শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন। আমি তাদের প্রতিনিধিত্ব করতেই সরকারে এসেছি। আমার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া দিয়ে আমার সামনের ভূমিকা নির্ধারিত হবে না। আমরা মানুষের কাছে গিয়েছি, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করছি, সেইসব মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা সেটাই আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
সমকাল: ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশ জাতীয় নেতা পেয়ে থাকে। আপনাদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আমরা এক গুচ্ছ ছাত্রনেতা পেয়েছি। সেই জায়গা থেকে জাতীয় নেতা হিসেবেও আপনার কাজ থাকতে পারে, মানুষও সেটা চাইতে পারে?
নাহিদ: হয়তো আমাদের ২/৩ জনকে সামনে বেশি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কাজ করছি একটা সম্মিলিত শক্তি হিসেবে। সামনে যদি দেশ পুনর্গঠনের জন্য আমাদের সরাসরি রাজনীতিতে আসতে হয়, জনগণ চাইলে আমরা সেখানে আসবো। ৫ বছর ১০ বছর যাই হোক, মানুষের চাওয়া অনুযায়ী আমাদের ভবিষ্যৎ ঠিক হবে। আমরা তো জনগণের আকাঙ্ক্ষা ডাকে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
সমকাল: আপনাকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ।
নাহিদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।