বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস (১৪ ডিসেম্বর) উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকাগুলোয় এ বিষয়ে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি বড় প্রশ্ন ছিল- বুদ্ধিজীবী হত্যার কারণে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বিশেষত শিক্ষায়তনিক অঙ্গনে যে শূন্যতার সৃষ্টি; তা পূরণ হয়েছে কিনা? প্রায় সবারই মতামত নেতিবাচক। সেই সঙ্গে আমার প্রশ্ন- কিছু পূরণও কি হয়নি?
সন্দেহ নেই, পাকিস্তানি বাহিনী তাদের স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ডের সূচনা ঘটায় এবং তা চলে স্বাধীনতার কিছু সময় পরও। স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্রকার (বুদ্ধিজীবী) জহির রায়হান হত্যা তার প্রমাণ। বিষয়টির মনোযোগী বিশ্নেষণে ধরা পড়ে, এই পরিকল্পিত শূন্যতা সৃষ্টির অপচেষ্টার শুরু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্ন থেকেই।
এর পেছনে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গোপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববঙ্গকে শুধু মেধাশূন্য করাই নয়; জনসংখ্যা বিচারে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় জনসংখ্যালঘু অঞ্চলে পরিণত করা। এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। তবে পদ্ধতিটা তখন ছিল ভিন্ন। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে হিন্দু জনসংখ্যা, বিশেষভাবে মেধাবী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাস্তুভিটা থেকে বিতাড়ন। এ অপচেষ্টা অনেকাংশে সফল হয় ১৯৫০ ও ৬৪ সালের ভয়াবহ দাঙ্গায়।
শুরুটা সাতচল্লিশের পর থেকেই এবং তা দাঙ্গাসহ আতঙ্ক সৃষ্টি এবং প্ররোচনাসহ নানা ঘটনার মাধ্যমে। ফলে বিপুল সংখ্যায় পূর্বোক্তদের দেশত্যাগ। এর নেতিবাচক প্রভাব সর্বাধিক মাত্রায় পড়ে শিক্ষাঙ্গনে। একের পর এক মেধাবী শিক্ষকের দেশত্যাগ। আমার ছাত্রাবস্থা তখন শেষ হয়নি। তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো বলছি। ওই শূন্যতা অনেক দিন ধরে চলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চরম শিকার। শুনেছি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন বসুকে নাকি চলে যেতে বাধ্য করা হয়। চলে যান খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ রমেশ মজুমদার। যান ডিএমসি (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) থেকে মেধাবী শিক্ষক পশুপতি বাবুও। এ কারণে ডিএমসির প্রাথমিক পর্বের ছাত্রদের মিটফোর্ড স্কুলে গিয়ে অ্যানাটমির পাঠ নিতে হয়। কী হাস্যকর ঘটনা! পাকিস্তানি শাসকদের ইচ্ছাপূরণ হলেও ওই শূন্যতা কি গুণগত মানে সম্পূর্ণ পূরণ হয়েছে? হলে কতটা হয়েছে? শিক্ষার নানা শাখায় গবেষণাকর্মের ঘাটতি কি অস্বীকার করা যায়?
দুই.
এ ধারাবাহিকতা পাকিস্তানি শাসক তাদের গোটা শাসনকালে অব্যাহত রেখেছে। রক্ত ঝরেছে অনেক। বিশেষ করে সামরিক-আধাসামরিক শাসনামলে। এর সর্বাধিক পর্যায় একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে সূচিত ৯ মাসের গণহত্যাকালে। তবে ডিসেম্বরে পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার কথা রাও ফরমান আলির ডেস্ক ক্যালেন্ডারে রয়েছে, যদিও তিনি এ অভযোগ বরাবর অস্বীকার করেছেন। তিনি চতুর বুদ্ধিজীবী ধরনের সামরিক কর্মকর্তা; নিয়াজির মতো স্থূল প্রকৃতির নন। তারা বরং আরও মারাত্মক, মুখোশধারী বলে। তারা সাহায্য নিয়েছে স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রমুখ ঘাতক বাহিনীর।
এবার মূল প্রশ্নের জবাবে বলি, জাগতিক-বৈজ্ঞানিক সূত্রে ওই যে বলা হয়, কোনো শূন্যতাই অপূর্ণ থাকে না- এ কথা বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের জন্য সাধারণ সূত্র হিসেবে কতটা সত্য; বাস্তব পরিস্থিতিতে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এর অন্তত একটি কারণ, সংক্ষিপ্ত পথে অর্জনের প্রতি আমাদের মানসিক প্রবণতা, যা শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে, গবেষণার বৃত্তে বা সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ অর্জনের ক্ষেত্রে বিপজ্জনকই বলা চলে। জানি, সংশ্নিষ্টরা বৃত্তের সীমানায় এমন অভিযোগ স্বীকার করতে চাইবেন না।
যদি দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ তুলে ধরা যায়, তাহলেও কি তারা উত্থাপিত যুক্তি অস্বীকার করবেন? ধরা যাক, ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজনে সংশ্নিষ্ট দুর্যোগ-দুর্ভোগ এবং মৃত্যু ও রক্তস্নানের বিষয়টি নিয়ে বিভাগ-উত্তরকালে ভারতীয় ও পশ্চিমা গবেষকরা এত মাত্রায় গবেষণাপত্র তৈরি করেছেন; তার ফলে বিপুলায়তন 'পার্টিশন সাহিত্য' সৃষ্টি হয়েছে। কেউ একে চিহ্নিত করেন সাউথ এশিয়ান ক্রাইসিস, কেউ 'গ্রেট ট্র্যাজেডি' বলে। 'ক্ষমতার হস্তান্তর' নামে রচনার প্রাধান্য লক্ষণীয়।
এ ঘটনায় যে সংখ্যক বাস্তুত্যাগ তথা অভিবাসনের মর্মযন্ত্রণার প্রতিফলন ঘটেছে, তা কারও মতে চরম অমানবিকতার ট্র্যাজিক চিত্র। ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি মিলে ইতিহাসের এক অবিশ্বাস্য কালো অধ্যায় এই দেশ বিভাগ তথা 'পার্টিশন'। এর নিকৃষ্ট উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে ত্রিধাবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশ। তাদের সবুজ, গেরুয়া ও লাল-সবুজ পতাকার প্রতীকে।


'ক্ষমতার হস্তান্তর' কালো অধ্যায়-ভিন্ন ভাষ্যে 'পার্টিশন'-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক এ ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশি ধীমানদের গবেষণাগত উদাসীনতা আমার বক্তব্যের পক্ষে একটি বড় প্রমাণ। এখানেই শেষ নয়। এই ট্র্যাজেডির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট বড় ঘটনা- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যা বিভাগ-পূর্ব ও বিভাগ-উত্তরকালে সংঘটিত হয়েছে। যারা ওইসব ঘটনার সাক্ষী তাদের অনেকের চোখে এখনও তা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। দীর্ঘ সময়ও এসব মুছে নিতে পারেনি।
এই দুঃস্বপ্নের মর্মযন্ত্রণা ও রক্তস্নান নিয়ে প্রধানত ভারতে বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট গবেষণাধর্মী ইতিহাসচিত্র রচিত হয়েছে। এ বিষয়ে আমার সংগৃহীত পুস্তকাদির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা চলে শৈলেশ মুখোপাধ্যায়, সুরঞ্জন দাস, শুভ্রাংশু ভট্টাচার্য বা সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি ও অবাঙালি ভারতীয় এবং পল রিচার্ড ব্রাস প্রমুখ বিদেশি (পশ্চিমা) লেখক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ওপর আলোকপাত করেছেন। সেখানে ইতিহাস ও বিশ্নেষণ দুই-ই স্থান পেয়েছে। শেষোক্তদের লেখায় বিশ্বের নানান দেশের জাতিগত দাঙ্গার বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত।
তিন.
তুলনামূলক বিচারে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। বিপুলায়তন পার্টিশন সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের গবেষণাধর্মী অবস্থান নিষ্প্রভ। আমাদের ইতিহাসবিদ, লেখক-গবেষকদের উদাসীনতা প্রকট। এর কারণ একাধিক। বিশদ বিশ্নেষণে বলতে গেলে সেটা তাদের জন্য বিব্রতকর হবে। তাদের করুণ অবস্থানটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তা উহ্য থাক। অবশ্য আমার জানামতে, বদরুদ্দীন উমর সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে লিখেছেন।
সাহিত্য-সাংস্কৃতিক গবেষণার এমন এক প্রেক্ষাপটে পূর্বোক্ত প্রশ্নের জবাব স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবারের বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস উপলক্ষে উল্লিখিত শূন্যতার প্রশ্নে সবাই যেখানে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন; সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শূন্যতা পূরণ হয়েছে সংখ্যাগত বিচারে; বিভিন্ন মাত্রায় গুণগত উৎকর্ষে নয়। শিক্ষাদানক্ষেত্রে বিরল সংখ্যক ব্যতিক্রমীদের কথা বাদ দিয়েই কথাটা বলেছি।
উন্নতমান শিক্ষাদান ও গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে বড় বাধা এ পেশাকে সাধনা হিসেবে গ্রহণ করতে অক্ষমতা এবং সেই সঙ্গে অর্থবিত্তখ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার প্রতি প্রবল আকর্ষণ, যা পেশাগত দায়িত্বকে ছাড়িয়ে যায়। মেধা যেসব ক্ষেত্রে উচ্চমানের, সেখানে মেধার সদ্ব্যবহারে অভাব (পূর্বোক্ত বাধাগুলোর কারণে বা অন্য কারণে) সব সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়। মেধা তখন আর সাধনার অঙ্গ হয়ে ওঠে না।
তাই উল্লিখিত উদাহরণগুলো সত্য হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানে বা বিজ্ঞানবহির্ভূত বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণায় বাংলাদেশি গবেষকরা আজ পর্যন্ত বিশ্বমানের কোনো আবিস্কারের কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছেন কি? কিংবা অনুরূপ জ্ঞানগর্ভ অর্জনের স্বীকৃতি পেয়েছেন কি? না পারার কারণ, পূর্বোক্ত গোড়ার গলদ।
১৯৪৭ থেকে ৭১-এ সৃষ্ট শূন্যতা সংখ্যাবিচারে পূরণ হলেও এর গুণগত উৎকর্ষ প্রত্যাশিত মাত্রায় বা বিশ্বমানের নিরিখে পূরণ হয়নি। ইউজিসির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কি এসব নিয়ে কখনও ভেবেছে কিংবা সর্বোচ্চ স্তরের শাসকবর্গ? প্রসঙ্গতই আরেকটি কথা, বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে আমরা এত কথা বলি, বেদনা প্রকাশ করি; কিন্তু এ বর্বরতার বিচার নিয়ে মাথা ঘামাই না। ঘাতকদের চিহ্নিত দু'একজন তো মহা আরামে বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ আছে। প্রবীণ সাংবাদিক গাফ্‌ফার চৌধুরীও এদের দুই-একজনের বর্তমান অবস্থান জানেন। অন্তত তেমন কারও কি বিচার করা যায় না? বিচার প্রশ্নটি নিয়ে একাধিকবার লিখেছি। আবারও লিখলাম শহীদ-পরিবারের বেদনার কথা ভেবে।
আহমদ রফিক :ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক কবি ও প্রাবন্ধিক