- মতামত
- ফস্কা গেরো
ফস্কা গেরো

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের বরাত দিয়ে বুধবার সমকালের এক প্রতিবেদনে রাইড শেয়ারিং সেবা উবারের যেসব বেআইনি ব্যবসায়িক কৌশল তুলে ধরা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। প্রতিবেদন অনুসারে, গার্ডিয়ান উবারের ২০১৩ থেকে '১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ১ লাখ ২৪ হাজার গোপন নথি পেয়েছে। সেগুলোর বিশ্নেষণে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা বিস্তারের লক্ষ্যে উবার দেশগুলোর ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ, বড় ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিপুল অঙ্কের ঘুষ দিয়ে গণপরিবহন-সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তন করিয়েছে।
এ প্রক্রিয়ায়, বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরোপের জনপ্রিয় ট্যাক্সি সেবাকে দুর্বল করে দিয়ে উবার একচেটিয়া ব্যবসা করার চেষ্টা করেছে। এ খবরগুলো উদ্বেগজনক এ কারণে যে, উবার আমাদের দেশেও বেশ জনপ্রিয় একটি রাইড শেয়ারিং সেবা। ওই অপকৌশলগুলো যে তারা এখানেও প্রয়োগ করছে না, তা বলা যায় না। যেমন, দেশে সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ বা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিবন্ধনপ্রাপ্ত এমন আরও ১৩টি সেবা থাকলেও গাড়ির জন্য প্রায় সব মানুষ উবারের কাছেই যায়। অর্থাৎ অন্তত গাড়ি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উবার এখানে প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা করছে।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশেষ করে ঢাকায় দুই ধরনের ট্যাক্সি সেবা চালু ছিল। সেবাটি বেশ জনপ্রিয় হওয়ার পরও একটা সময়ে অজানা এক কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে আবার ট্যাক্সি সেবা চালু হলেও ভাড়ার হার এত বেশি রাখা হয়, যা সাধারণ মধ্যবিত্তের পক্ষে; যারা বোধগম্য কারণেই এ ধরনের সেবার আসল গ্রাহক; এ সেবা গ্রহণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
তারপর ২০১৬ সালের দিকে, আমরা ঢাকার রাস্তায় উবার সেবা চালু হতে দেখি। ওই ট্যাক্সি সেবাকে দুর্মূল্য করে দেওয়ার পেছনে কি এর কোনো যোগ ছিল? প্রশ্নটির উত্তর সহজলভ্য না হলেও একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ নিয়ে উবার যে অনেক ক্ষেত্রেই এখানকার যাত্রীদের পকেট কাটায় সচেষ্ট, তার উদাহরণ এখন বিরল নয়। যেমন সর্বশেষ লকডাউন-পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ গত বছরের শেষদিক থেকে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই উবারের ভাড়া বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। একই সঙ্গে চালকদের কাছ থেকে ভ্যাটসহ কমিশন বাবদ ৩০ শতাংশ কেটে নেওয়া হচ্ছে।
এর ফলে একদিকে গাড়ি কমে গেছে, আরেকদিকে চালকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে যাত্রী হয়রানির প্রবণতা। এমনও অভিযোগ আছে, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সির মতো উবার চালকরাও অনেক সময় যাত্রীদের চুক্তির ভিত্তিতে গন্তব্যে যেতে বাধ্য করে। আরও দুঃখজনক হলো, বারবার অভিযোগ করার পরও উবার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এসবের কোনো প্রতিকার মেলে না। বিআরটিএর নাকের ডগায় যাত্রী হয়রানির এসব ঘটনা ঘটলেও তারা তা বন্ধে এগিয়ে আসছে না।
যদিও বিআরটিএ বলছে, অভিযোগ পেলে তারা রাইড শেয়ারিং সেবাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিধা করবে না। সমকালের একই দিনের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাইড শেয়ারিংয়ের অনুমতি নিলেও 'পাঠাও' ফুড ডেলিভারি, কুরিয়ার সেবা, পার্সেল বহন ইত্যাদি খাতেও রমরমা বাণিজ্য করছে এবং এসব ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফার টাকা ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ। তাদের মতে, এটি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ধারায় একটি 'অপরাধ'। প্রতিবেদনে এমনও বলা হয়েছে, ওই অর্থ যার হিসাবে পাঠানো হয়েছে তার বিরুদ্ধে অনলাইন জুয়ায় জড়িত থাকার তথ্য সংশ্নিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের হাতে আছে। বিআরটিএ যতই বলুক; রাইড শেয়ারিং সেবাগুলোকে তারা বজ্র আঁটুনিতে বেঁধেছে। আসলে তাদের গেরো ফস্কাই রয়ে গেছে।
রাইড শেয়ারিং সেবার ধারণাটি শুধু অভিনব নয়; একটা ব্যস্ত শহরে নানা কারণে সৃষ্ট গণপরিবহন সংকট সমাধানের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সহায়ক। কিন্তু উপযুক্ত নীতিমালা ও যথাযথ নজরদারির অভাবে তা যে যাত্রীসাধারণের বিড়ম্বনা শুধু নয়; জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিও হুমকির কারণ হতে পারে; উবার ও পাঠাওয়ের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ তারই সাক্ষ্য বহন করে। সংশ্নিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অবিলম্বে তৎপর হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন