অর্থনীতিবিদ ও লেখক ড. মাহবুব উল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। পাশাপাশি ১৯৯৩-'৯৭ মেয়াদে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য এবং ২০০৩-২০০৬ মেয়াদে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া বিআইডিএস, রেভিনিউ রিফর্মস কমিশন এবং উচ্চশিক্ষা বিষয়ক কৌশলপত্র প্রণয়ন কমিটিতে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর, ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৯০ সালে ভারতের জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ষাটের দশকে তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক; স্বাধীনতার পর ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন। মাহবুব উল্লাহর জন্ম ১৯৪৫ সালে, নোয়াখালীতে।
সমকাল: আমরা জানি, অবিভক্ত বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সম্পর্কে আপনার নানা।
মাহবুব উল্লাহ: আমার আপন নানা মাওলানা মকবুল আহমদ। তাঁর ছোট ভাই খুরশিদ আহমদ। আর তৃতীয় জন হলেন কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। তাঁদের আরেক ভাই শৈশবেই মারা গেছেন। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ বিয়ে করলেও অন্যদের মতো পারিবারিক জীবনযাপন করেননি। তাঁর স্ত্রী, আমাদের সেই নানির নাম ছিল হাফেজা খাতুন। সন্দ্বীপের বাড়িতে একটি ছোট ঘরে একাই থাকতেন। শৈশবে শীতের দিনে আমরা যখন বেড়াতে যেতাম, তখন দু'একজন সেই ঘরে তাঁর সঙ্গে থাকতাম। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের আসা-যাওয়া না থাকলেও স্বামীর ঘর হিসেবে তিনি সেখানেই পড়ে থাকতেন। সাধারণ জীবনযাপন করতেন।
সমকাল: আপনাদের সঙ্গে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের যোগাযোগ ছিল?
মাহবুব উল্লাহ: দেশ ভাগের পর তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাঁকে এখানে থাকতে দিল না। বাধ্য হয়ে চলে গেলেন কলকাতা। সেই থেকেই তিনি ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ওখানেই ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে আফিফা খাতুন এখানেই ছিলেন। তবে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ পরিবারের সবার খোঁজখবর রাখতেন। আমাকে বেনামে চিঠিপত্র লিখতেন। তাঁর ভাষা ছিল খুবই মার্জিত। হাতের লেখাও ছিল খুব সুন্দর। মায়ের কাছ থেকে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নজরুল সন্দ্বীপেও গেছেন; নানার কাচারি ঘরে বসে গান গাইতেন। আমার মা বলতেন, নজরুল বাকশক্তি হারিয়েছেন গান গাওয়ার সময় বেশি মাথা ঝাঁকানোর কারণে।
সমকাল: নানার সঙ্গে কখনও সরাসরি দেখা হয়েছে?
মাহবুব উল্লাহ: মৃত্যুর এক বছর আগে ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে তিনি নামলেন। সেখানে তাঁকে রিসিভ করার জন্য আমি উপস্থিত ছিলাম। তারপর তিনি চলে গেলেন আমার খালা, মানে তাঁর মেয়ের বাসায়। আমার সেই খালার বিয়ে হয়েছিল 'ছান্দসিক কবি' আব্দুল কাদিরের সঙ্গে। বাড়ি ছিল গুলশানে; একতলা ভবন। দেখলাম, ঘরভরা মানুষ। তিনি গর্ব করে বললেন, বংশের মধ্যে একমাত্র আমিই তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ধরে রেখেছি।
সমকাল: আসলেই নানার প্রভাবে বামপন্থি রাজনীতিতে এসেছিলেন?
মাহবুব উল্লাহ: আমার বাবা চাইতেন, আমি সিএসএস পরীক্ষা দিয়ে আমলা হই। কিন্তু বামপন্থি চিন্তাধারার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকেই। আমার নানা যেহেতু মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ, তাই কৌতূহলটা বেশিই ছিল। এ ছাড়া বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলাম। অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ছিলেন ড. আবু মাহমুদ। তিনি ছিলেন মার্কসবাদী। তাঁরও একটা প্রভাব আছে। তিনি শ্রেণি পাঠে পুঁজিবাদী তত্ত্বকে ক্রিটিক করে বিকল্প তত্ত্ব দিতেন। এর পর তো ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হয়ে গেলাম। ততদিনে ছাত্র ইউনিয়ন ভাগ হয়ে গেছে। আমাদের নেতা ছিলেন রাশেদ খান মেনন।
সমকাল: স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা ঘোষণা আপনার রাজনৈতিক জীবনের একটি বড় অধ্যায়।
মাহবুব উল্লাহ: এই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রেই রয়েছে। ষাটের দশকের শেষদিকে আমরা দেখলাম, বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে জোয়ার উঠেছে, সে জোয়ার রোধ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের মনে প্রশ্ন থাকল- প্রকৃত স্বাধীনতা কি আসবে? আমাদের বিশ্বাস ছিল, আওয়ামী লীগের শ্রেণি-চরিত্রের কারণেই মানুষ কাঙ্ক্ষিত ফল পাবে না। তখন চীনপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি বলত, তারা জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা চায়। কিন্তু স্বাধীনতার বিষয়টি তারা সামনে আনতে চায়নি। আমরা দেখলাম, সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে চীনপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিও ভাগ হয়ে গেছে। আমরা যোগাযোগ করলাম মেনন ও কাজী জাফরের সঙ্গে। তাঁরা না চাইলে সাংগঠনিকভাবে উত্থাপন করা যাবে না। দু'তিন দিন পর বললেন, আপত্তি নেই। ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পল্টনে আহূত জনসভায় আমি বক্তৃতা দিলাম এবং কর্মসূচি উত্থাপন করলাম। সেখানে মেনন, কাজী জাফরসহ অন্যান্য নেতা বক্তব্য রাখলেন। আমার ছোট ভাই মাহফুজ উল্লাহ প্রস্তাবটা পড়ল।
সমকাল: কী প্রতিক্রিয়া হলো?
মাহবুব উল্লাহ: মজার বিষয়, ইত্তেফাক পত্রিকা উৎসাহী হয়ে আমাদের 'উস্কানিদাতা' আখ্যা দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিল। আমাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেল। সামরিক আইনে মামলায় প্রধান অভিযোগ- পাকিস্তানের ভৌগোলিক অখণ্ডতা হুমকিতে ফেলা। দ্বিতীয় অভিযোগ- সামরিক আইনের সমালোচনা। এর পর আমি গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম।
সমকাল: কীভাবে গ্রেপ্তার হলেন?
মাহবুব উল্লাহ: পল্টনের কর্মসূচির পর থেকে আমি বাসার বদলে হলে গিয়ে থাকতাম। কারণ তখনকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল সুরক্ষিত এলাকা। মার্চ মাসে চাঁদপুর অঞ্চলের নেতা বিএম কলিমুল্লাহ আমার কাছে এসে বললেন, মওলানা ভাসানীকে যেন রাজি করাই তাঁর এলাকায় একটা জনসভা করতে। আমি বললাম, মওলানা সাহেবকে পাওয়া যাবে না; আজই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাবেন। আমাদের এক কর্মী বলল, আমার গাড়ি আছে। আপনাকে দ্রুত বিমানবন্দরে নিয়ে আবার ফিরিয়ে আনতে পারব। আমি রাজি হলাম। বিমানবন্দরে মওলানা সাহেবের চারপাশে অনেক ভিড়। এর মধ্যে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কারও নামে হুলিয়া আছে কিনা। আমি বললাম, আমার নামে আছে। তিনি বললেন, এসবির লোকরা চলে এসেছে। আমি তাড়াতাড়ি বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে একজন ডেকে নিজেকে ডিএসপি লোদি হিসেবে পরিচয় দিলেন। বললেন, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো। আমি বললাম, কী অভিযোগ? তিনি বললেন, গেলেই জানতে পারবেন। এর পর জিপে চড়িয়ে প্রথমে রমনা থানায়, সেখান থেকে সোজা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে গেল। গ্রেপ্তার হলাম ২১ মার্চ। সপ্তাহখানেক পর সামরিক আদালতে সামারি ট্রায়াল হলো।
সমকাল: বিচারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরেকটু বলুন।
মাহবুব উল্লাহ: একজন মেজর বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি দু'চার কথা শুনেই রায় ঘোষণা করলেন- এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১৫ বেত্রদণ্ড। কোর্ট দারোগা হিন্দু ভদ্রলোক বললেন, ১৫ বেত্রদণ্ডে আপনার প্রাণহানি বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। একটা মার্সি পিটিশন দেন। বললাম- মরলে মরে যাব; এদের কাছে মার্জনা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু জেলে বসে পরের দিন পত্রিকায় যে সংবাদ এলো, তাতে বেত্রদণ্ডের কথা ছিল না। আমি চিরকুট লিখলাম স্ত্রীর কাছে। সে একটি বিবৃতি দিল- আমার স্বামীকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছে, জানানো হোক। আইএসপিআর জানিয়েছিল, তাঁকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পরে শুনেছি, মেজরের রায় চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তা সংশোধন করেছিলেন।
সমকাল: আপনি কারাগারে থাকতেই তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। ভেতরে থেকে কীভাবে টের পাচ্ছিলেন?
মাহবুব উল্লাহ: সংবাদপত্রে ঘটনাবলি অনুসরণ করছিলাম। ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, অবজারভার, ডন ও পাকিস্তান টাইমস পাওয়া যেত। এসব পত্রিকায় ছাপা হতো 'দুস্কৃতকারীরা' কোথায় কী করেছে। সেটা দেখে আমরা মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বুঝতাম। জেল কর্মকর্তাদের কেউ কেউ খোঁজখবর দিতেন। ডেপুটি জেলার শামসুর রহমান রাজবন্দিদের পছন্দ করতেন। ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করল। কারাগারে উৎসবের আমেজ। ডেপুটি জেলার মিষ্টি নিয়ে এলেন রাজবন্দিদের জন্য।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনারা কতজন রাজবন্দি ছিলেন?
মাহবুব উল্লাহ: সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ জন। এর মধ্যে বামপন্থি ৪-৫ জন। তেল-গ্যাস আন্দোলনের ইঞ্জিনিয়ার শহিদুল্লাহ, সরদার ফজলুল করিম ও কামরুদ্দিন আহমদ আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
সমকাল: কারাগার থেকে বের হলেন কীভাবে?
মাহবুব উল্লাহ: জেলার নির্মল রায় ছিলেন নিয়মনিষ্ঠ ব্যক্তি। যে কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীও তাঁকে হত্যা বা পদচ্যুত করেনি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর তিনি বললেন- মুক্তির জন্য নতুন সরকারের অনুমোদন লাগবে। জেলের একজন কম্পাউন্ডার ছিলেন অতিউৎসাহী আওয়ামী লীগার। তিনি সারা শহর খুঁজে মুজিবনগর সরকারের কাউকে পেলেন না। শেষ পর্যন্ত বুদ্ধি করে জেনারেল অরোরার কাছে চলে গেলেন। অরোরা তাঁর নোটশিট থেকে একটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে শুধু এক লাইন লিখলেন- 'রিটার্ন অল প্রিজনারস ইন প্রিজন বাই দ্য মার্শাল ল অব পাকিস্তান।' কাগজটা এনে জেলারের কাছে দেওয়ার পরদিন সকাল ১০-১১টার মধ্যে পুরো কারাগার খালি। শুধু রাজবন্দি নয়; সব ফৌজদারি অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া হলো। ছাড়া পেয়ে দেখি, আমার এক খালু কোথায় যেন খবর পেয়ে জেলগেটে এসেছেন।
সমকাল: একটি সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, কারাগার থেকে বের হয়ে বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।
মাহবুব উল্লাহ: ডিসেম্বরের ১৮ কি ১৯ তারিখ হবে। আমি, আমার স্ত্রী ও ছোট ভাই মাহফুজ উল্লাহ ধানমন্ডির পুরোনো ১৮ নম্বর রোডের বাড়িতে গেলাম। সেখানে একতলা বাড়িতে বেগম মুজিবকে রাখা হয়েছিল। সেখানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাও ছিলেন। শেখ হাসিনার কোলে জয়কে দেখেছিলাম। বেগম মুজিব বললেন- বাবা, আমি তো শুনেছি, তোমাকে মেরে ফেলেছে! তুমি বেঁচে আছ! তারপর আমাদের চা-বিস্কিট দিলেন। অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে এলাম। এর মধ্যে রাজনৈতিক কোনো বিষয় নেই। সামাজিক সম্পর্কের কারণে গিয়েছিলাম খোঁজ-খবর নিতে। সেটাও পরদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় সংবাদ হয়েছিল।
সমকাল: স্বাধীন বাংলাদেশে তো আপনি ভাসানী ন্যাপে যোগ দিলেন।
মাহবুব উল্লাহ: মওলানা সাহেব যেদিন ভারত থেকে দেশে এসে পৌঁছালেন, সেদিনই আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় ছিলেন, কীভাবে ছিলেন? তিনি প্রথমে বলতে চাচ্ছিলেন না। তিনি বললেন- ইন্দিরা আমার স্নেহের। তাঁর বাবার সঙ্গে রাজনীতি করেছি; আমাকে কি অযত্ন করবে? অনেক খাতির-যত্ন করেছে ইত্যাদি। অনেক চাপাচাপি করার পর তিনি ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বললেন- বুঝই তো, আমি ভিন্নমতের মানুষ! আমরা মূলত বোঝার চেষ্টা করছিলাম, মওলানা সাহেব ভারতে নজরবন্দিতে ছিলেন কিনা।
সমকাল: পরিবার থেকে আপনাকে আবার রাজনীতিতে যোগ দিতে দিল?
মাহবুব উল্লাহ: বাবার মত ততদিনে পরিবর্তন হয়েছে। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় আমি ছাত্রনেতা; বড় বড় জনসভায় বক্তব্য দিই। শেখ সাহেব তো ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি যে সংবর্ধনা সভা হয়, সেখানেও বক্তব্য দিয়েছি। আমার বাবা তখন কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ। তিনি কুমিল্লা থেকে ট্রেনে ঢাকা আসছিলেন একজন সহকর্মীকে নিয়ে, চিকিৎসার জন্য। ট্রেনে উঠে দেখেন, একটি আসনও খালি নেই। ছাত্র দিয়ে ভরা; তারা ঢাকার জনসভায় যাবে। তারা গল্প করছিল, ছাত্রনেতা মাহবুব উল্লাহ কেমন বক্তব্য দেয়। এটা শুনে বাবার সহকর্মী তাঁদের বললেন, ইনি মাহবুব উল্লাহর বাবা। এ কথা শুনে সবাই আসন খালি করে দিল এবং বলল, আপনি শুয়ে যান। এই ঘটনার পর বাবা বললেন- আমি তো তার রাজনীতি পছন্দ করতাম না। এখন তো দেখি, সে ভালো কাজ করছে।
সমকাল: ন্যাপ থেকে সরে এসেছিলেন কেন?
মাহবুব উল্লাহ: ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে মওলানা ভাসানীর কিছু বক্তব্য আমাদের বিভ্রান্ত করত। তিনি মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন। আমরা রাজনৈতিক ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেলাম। মুসলিম বাংলা করব- এটা কখনও চিন্তাও করিনি। তিনি ১৯৭২ সালে বলতেন, বাংলাদেশ এখনও অসম্পূর্ণ। আমাদের ১৪টা জেলা বাংলাদেশের বাইরে রয়ে গেছে। যতদিন এগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত না হবে, ততদিন সত্যিকারের বাংলাদেশ হবে না। যদিও আমরা এটা নিয়ে অত বিব্রত হতাম না। কারণ বৃহৎ বঙ্গের ঐতিহাসিক বাস্তবতা রয়েছে।
সমকাল: এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন?
মাহবুব উল্লাহ: আমরা ভিন্নমতের ছিলাম, কিন্তু ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল না। একদিন সন্ধ্যায় শেখ সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেওয়া সময় অনুযায়ী সাক্ষাৎ করতে গেলাম সুগন্ধা ভবনে। ফরাসউদ্দিন ছিলেন তাঁর পিএস, আর রফিকউল্লাহ চৌধুরী ছিলেন মুখ্য সচিব। গেটের কাছে তাঁদের অফিসে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ইন্টারকমে ডাক পড়ল। চায়ের কাপ ফেলে রেখেই গিয়ে গিয়ে দেখি একটি হলরুমে তিনি এক-দেড়শ লোক নিয়ে বসে আছেন। আমি চিন্তা করলাম, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি এত লোকের সঙ্গে বসে থাকেন, তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে মনোযোগ দেবেন কখন! আমরা কি কথা বলার পরিবেশ পাব! তবুও দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম। দেখেই তিনি বললেন- এই নেতা এসে গেছে, তোরা সব চলে যা! বিস্ময়করভাবে মুহূর্তের মধ্যেই হল খালি হয়ে গেল! তারপর আমাদের নিয়ে বসলেন বারান্দায়। সেখানে বেতের সোফা ও টেবিল পাতা। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন- হুজুর কী কয়? আমি বললাম, কী কয় তা তো আপনি নিজে দেখছেন। বাংলাদেশ অসম্পূর্ণ; ১৪টি জেলা বাইরে। শেখ সাহেব বললেন, এটা তো প্রিম্যাচিউর স্লোগান। তারপর বললেন, যেসব এলাকা বাইরে আছে, আগে ওদের দিল্লি থেকে বের হয়ে আসতে দে। তারপর আমি দেখব।
সমকাল: শিক্ষকতায় এলেন কীভাবে?
মাহবুব উল্লাহ: রাজনৈতিক বিরোধের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক পরীক্ষায় আমার ভালো ফল কেড়ে নিয়েছিলেন। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আমাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অনেকটা জোর করে। আবেদনের সব আনুষ্ঠানিকতা তিনি নিজে সেরে দিয়েছেন। আমাকে বললেন, একটি বছর অন্তত শিক্ষকতা করেন। তারপর চাইলে ছেড়ে দিয়েন। সেখান থেকেই শিক্ষকতার মজা পেয়ে যাই।
সমকাল: সমকালেই একটি নিবন্ধে আপনি মাও সে তুংকে উদ্ৃব্দত করেছিলেন- যেসব বুদ্ধিজীবী প্রকৃত বুলেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি, তাঁরাই চিনির আস্তরণমাখা বুলেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। বাংলাদেশেও কি সেটাই ঘটেছে?
মাহবুব উল্লাহ: চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে মাও কথাটি বলেছিলেন। চীনের বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় আমরা আরও অধম। বুদ্ধিজীবীরা জাতির সামনে ভালোমন্দ মতামত তুলে ধরবেন। পার্থক্য থাকবে আদর্শিক। কেউ লিবারেল বা মার্কসবাদী বা ইসলামপন্থি হতেই পারেন। কিন্তু আজকে নেহাত প্রাপ্তিযোগের জন্য বুদ্ধিজীবীরা যা করছেন, এসব দেখে খুব খারাপ লাগে। আসলে স্বাধীনতার পর থেকেই অনেক বুদ্ধিজীবী পদ-পদবির জন্য আত্মসমর্পণ করতে থাকলেন।
সমকাল: এভাবে আত্মসমর্পণের কারণ কী?
মাহবুব উল্লাহ: মূল কারণ নৈতিক স্খলন। আমাদের বুদ্ধিজীবী অনেকের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে। সমাজকে সঠিক পথে রাখতে বুদ্ধিজীবীরা যে ভূমিকাটা পালন করতে পারতেন; বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবীরা এখনও সেটা পালন করেন। আমাদের এখানে সেটা স্বাধীনতার পর থেকেই ব্যর্থ হয়েছে। এর সঙ্গে চিন্তার জগতে সংকীর্ণতা রয়েছে। আর রাজনৈতিক চাপ তো আছেই। সমাজে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা খুব সহজ নয়। স্রোতের বিরুদ্ধে যারা সাঁতার কাটার চেষ্টা করে, তাদের বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। দেখবেন, কলামে আমি যে কথা বলতে চাই; তা এখন ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলি। কে এই শেষ বয়সে এসে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা খেতে যাবে?
সমকাল: আপনি আত্মজীবনী লিখছেন। দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য জীবন পেরিয়ে এসে কোনো আক্ষেপ হয়?
মাহবুব উল্লাহ: আমার আক্ষেপ একটাই- যেভাবে চিন্তা করেছি, সেই বাংলাদেশটা হলো না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তি আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে দেবে না। এ উপমহাদেশে বাংলাদেশ একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ণতা পাক- এটা অনেক রাষ্ট্রই চাইবে না। তার সঙ্গে আমরা নিজেরা চরিত্র, চিন্তা ও চেতনার দিক থেকে দুর্বল হয়ে গেছি। আমাদের ভেতরকার যে শক্তি, সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে।
সমকাল: এই সাক্ষাৎকার যেদিন প্রকাশ হবে, সেদিন আপনার জন্মদিন। সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা।
মাহবুব উল্লাহ: সমকালের জন্যও শুভ কামনা।