ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

আত্মতুষ্টি নয়, বাস্তবতা অনুধাবন জরুরি

পানি দিবস

আত্মতুষ্টি নয়, বাস্তবতা অনুধাবন জরুরি

খায়রুল ইসলাম

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৩ | ১৮:০০

এ বছর বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্যে পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধান ত্বরান্বিত করার কথা বলা হয়েছে। পানি ও স্যানিটেশনের গুরুত্ব বোঝার জন্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তখন শরণার্থী হিসেবে আমাদের প্রায় এক কোটি মানুষ প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেয়। এমনিতেই শরণার্থী শিবিরগুলো ছিল ডোবা-নালার কাছে। জুন-জুলাই মাসের দিকে বর্ষাকালে প্রবল বর্ষণে মানুষের মল-মূত্র আর পানি একাকার হয়ে যায়। ফলে সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে সেখানে কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটে।

শাহাদুজ্জামান ও আমার গবেষণায় এসেছে, ওই সময় কলেরায় প্রায় ৩ লাখ ১৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেখান থেকে আমাদের পানি স্যানিটেশনের কার্যক্রম শুরু। ১৯৬৮ সালে ওরস্যালাইন আবিষ্কারের পর ১৯৭১ সালে শরণার্থী শিবিরে আমরা ব্যাপকভাবে এর প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হই। ভারতীয় সরকার ও মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোর সহায়তায় শরণার্থী শিবিরে টিউবওয়েল ও ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়। পানি ও স্যানিটেশনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্যই প্রসঙ্গটির অবতারণা।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা ছিল। ধীরে ধীরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা ২০১০-১১ সালের দিকে ভালো অবস্থানে পৌঁছি। এমডিজির লক্ষ্যমাত্রার সময়সীমা তথা ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ মৌলিক পানির অধিকারের আওতায় আসে। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের যত মানুষ যখন খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করত, সেদিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বেশ ভালো। পানিতে আর্সেনিক রোধে গভীর নলকূপ স্থাপনে আমাদের সাফল্য ছিল উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, এ সময়ের ৯৭ শতাংশ মানুষের যে পানির কথা আমরা বলছি, সেটা যে একেবারে সুপেয় ছিল, তা নয়। এর পরও এই অর্জন নিয়ে আমাদের মধ্যে বিশেষ করে নীতিনির্ধারকরা ব্যাপক আত্মতুষ্টিতে ভোগেন।

২০১৫ সালের পর যখন এসডিজির যুগে আমরা প্রবেশ করি, স্বাভাবিকভাবেই টেকসই লক্ষ্যমাত্রায় পানির সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন আসে। এখানে সুপেয় পানি বা পানির অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি নিরাপদ কিনা; তাতে রোগ-জীবাণু ও আর্সেনিক আছে কিনা; ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে পানি আছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ও দেখা হয়। এসডিজির সংজ্ঞা অনুযায়ী, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের আওতার মানুষের হার ৯৭ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশে নেমে যায়। এই পতনের পরও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আগের মতো সেই আত্মতুষ্টিই আমরা দেখছি।

মনে রাখতে হবে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি; রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। এখন পানির মধ্যে রোগ-জীবাণু থাকলে সেটা কেউই খেতে চাইবে না। অথচ ওয়াসা কিংবা পৌরসভাগুলো যে পানি বিতরণ করে তা কতটা নিরাপদ? গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা ওয়াসার পানিতে রয়েছে ই-কোলাই নামের ব্যাকটেরিয়া। যেটা মূলত মানুষের মলের মাধ্যমে ছড়ায়। সুতরাং পানির ক্ষেত্রে আমাদের যে অর্জন, গুণগত মানের দিক থেকে তা প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের যে ব্যবস্থা ও গতি– তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে যেখানে ৬৩ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানির ব্যবস্থা ছিল, ২০২০ সালে তা বেড়ে ৬৫ শতাংশ হয়। পাঁচ বছরে ২ শতাংশ হারে যদি বাড়ে তবে শতভাগ মানুষের নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হলে আরও কত বছর লাগবে, তা বোধগম্য।

পানি ও স্যানিটেশনে বৈষম্য একটি বড় বিষয়। যেমন ঢাকার গুলশানে বসবাসকারী মানুষ যতটা পানি ব্যবহার করে থাকে; বস্তিবাসী ততটা পারে না। সে জন্য এলাকাভিত্তিক পানির মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা চলছে। সেটা ভালো হতে পারে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন সূক্ষ্ম হিসাব করেই করা উচিত।


বৈষম্যের দ্বিতীয় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলীয় এলাকার মানুষ, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিপর্যস্ত, তাদেরকে জীবন বাঁচানোর জন্য পানি কিনতে হয়। সাতক্ষীরার আশাশুনি, কয়রা কিংবা শ্যামনগরের মানুষকে এক হাজার লিটার পানি কিনতে হয় ৫০০ টাকা দিয়ে। অথচ একই দেশের নাগরিক ঢাকায় বসে সেই পানি ক্রয় করে ১৫ টাকা ২০ পয়সায়। রাজশাহী ওয়াসা সেখানে ১০০০ লিটার পানি বিক্রি করছে ৭ টাকায়। উপকূলীয় মানুষকে কম গুণগত মানসম্পন্ন অল্প পানি শহরের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ দিয়ে কিনতে হয়। অথচ তারা দরিদ্র এলাকার মানুষ। শহরের মানুষের কম মূল্যে পানি পাওয়ার একটা কারণ হতে পারে, এখানে সরকারের প্রকল্প আছে। সেখান থেকে তারা মূলধনি ভর্তুকি পায়। প্রশ্ন হলো, উপকূলীয় এলাকায় সে রকম প্রকল্প কেন নেই?    

আরেকটি বৈষম্য ঘোচানোও জরুরি। শহরে আমরা যেভাবে বাথরুমে কিংবা কিচেনে পাইপ দিয়ে পানি পাই, গ্রামের মানুষদের সে ব্যবস্থা নেই। দূরের টিউবওয়েল বা পুকুর থেকে পানি এনে তাদের ব্যবহার করতে হয়। পাইপের মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষের রয়েছে, যারা প্রধানত নগরে বাস করছে। এই হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি আফগানিস্তানেও ২২ শতাংশ মানুষ পাইপের পানি ব্যবহার করে। অথচ সঠিক পরিকল্পনা করলে গ্রামের মানুষকে সহজেই এর আওতায় আনা সম্ভব। সরকার যে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্প করেছে, সেখানেও এ অবস্থা রাখা হয়নি। অথচ পাইপের পানি ঘরে ঘরে পৌঁছানো ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর মতোই সম্ভব। এই বৈষম্য দূর না হলে আমাদের পানি ও স্যানিটেশন পরিস্থিতির উন্নতি কঠিন হবে।

২০১৫ সালে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবার আগে পানি ও স্যানিটেশনে যে ভালো অবস্থানে ছিলাম, সেখান থেকে আমাদের অবস্থানের তেমন উন্নতি ঘটেনি। অথচ এর পর ভারত ও নেপাল এদিক থেকে ব্যাপক এগিয়েছে। ভারতের শৌচ ভারত মিশনের কথা বলতেই হবে। সেখানে স্যানিটারি ল্যাট্রিন নির্মাণসহ স্যানিটেশন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। নেপালের ব্যাপক উদ্যোগও উল্লেখযোগ্য। স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ যেখানে শতকরা ৫ পয়েন্ট এগিয়েছে, সেখানে নেপাল ও ভারত অর্জন করেছে শতকরা ১০ পয়েন্ট।

সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশনে এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারকে একটি সমন্বিত বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পিকেএসএফ, ডিপিএইচই, বিশ্বব্যাংক গ্রামাঞ্চলে এ ক্ষেত্রে স্যানিটেশনের প্রসারে যে কাজ করছে, তা খুব অল্প এলাকায় সীমাবদ্ধ। হতদরিদ্র যেসব পরিবার স্যানিটেশনের বাইরে রয়েছে, তাদেরকে বিনামূল্যে টয়লেট নির্মাণ করে দেওয়া ও সীমিত আয়ের মানুষদের ঋণ দিয়ে এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য এ ধরনের প্রকল্প আরও প্রসারিত করা দরকার।

পানি ও স্যানিটেশনে আমাদের সংকট ও বৈষম্য নিরসনের জন্য সর্বাগ্রে বাস্তবতা উপলব্ধি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে অবস্থার উত্তরণ কঠিন হবে। একই সঙ্গে বৈষম্য দূর করতে উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও জরুরি। মনে রাখতে হবে, পাইপে পানির ব্যবস্থা শহরের মানুষের যেমন প্রয়োজন, গ্রামের মানুষেরও প্রয়োজন। অন্য বিষয়গুলোও সবার ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব পেলে পানি ও স্যানিটেশনে পরিবর্তন ত্বরান্বিত হবে নিঃসন্দেহে।

খায়রুল ইসলাম : আঞ্চলিক পরিচালক, দক্ষিণ এশিয়া, ওয়াটার এইড 

আরও পড়ুন

×