কূটনীতি
বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে মার্কিন প্রত্যাশার ইতি-নেতি
এম. হুমায়ুন কবির
প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ২৩:১০
গণতন্ত্র একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষানির্ভর পদ্ধতি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র রয়েছে। তারা তাদের মতো করে গণতন্ত্র চর্চা করে। গণতন্ত্রে যে কোনো ঘাটতি নেই– এ কথা বলা যায় না। সম্ভবত এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সম্প্রতি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার গণতন্ত্র সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কয়েক বছর আগে একটি বই লিখেছিলেন। আমেরিকার হয়ে দুই মেয়াদে আট বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ওবামা সেখানে বলেছেন, ইউনাইটেড স্টেটস ইজ দ্য লার্জেস্ট এক্সপেরিমেন্ট ইন ডেমোক্রেসি। তিনিও দাবি করেননি যে তাঁরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। তার মানে, তাঁরাও দাবি করেননি তাঁদের দেশ গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ আসনে আছে কিংবা তাঁদের গণতন্ত্রে কোনো ঘাটতি নেই। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি ব্যাখ্যা করতে হবে। যেহেতু গণতন্ত্র একটি মনুষ্যসৃষ্ট বিষয় বা পদ্ধতি, তাই এতে ঘাটতি থাকবে– এটা স্বাভাবিক। যাঁরা গণতান্ত্রিক এই ব্যবস্থাটি আবিষ্কার করেছেন, তাঁরাও বলতে পারেন না– এটি কোনো প্রকার ত্রুটিমুক্ত পদ্ধতি। তবে এখন পর্যন্ত মানুষ যতগুলো শাসনপদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, তার মধ্যে গণতন্ত্র সবচেয়ে ভালো একটি পদ্ধতি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল আমাদের দেশকে স্বীকৃতি দেয়। অনেকে বলেন, এটা কি দেরি হয়ে গেল? আমিও মনে করি, আগেই দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু অপরপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বৈশ্বিক শক্তি, পরাশক্তি হিসেবে তার বৈশ্বিক অগ্রাধিকার আছে। সেই অগ্রাধিকারের কারণেই যুদ্ধের সময় যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিল, সেটা থেকে সরে এসে আমাদের স্বীকৃতি দিতে হয়েছে। নব্বই দশকে এসে সেই সম্পর্কের গুণগত উন্নয়ন লক্ষ্য করলাম। তৈরি পোশাক রপ্তানি করা শুরু করলাম। এরপর ১০ থেকে ১৫ বছর এভাবেই গেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের মধ্যে বড় মুক্তবাজার। কিন্তু তৈরি পোশাক যেটা আমরা পাঠাই, সেটার শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়নি।
আবার ২০০১ সাল থেকে সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। ২০০৬-০৭ সালে যখন আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামো একটি প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ে তখন গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য দেশটি জোরালো ভূমিকা পালন করেছে।
একই সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হতে থাকল। এতে তারাও মনে করল, এখন আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করা যায়। তারাও জানে, এভাবে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যাবে। কিন্তু তখন বর্তমানে প্রাপ্ত অনেক সুবিধা দেশটির জন্য মিলবে না। তাই বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেক বাড়াতে হবে। এ প্রক্রিয়ার অন্যতম অংশ হলো স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। এটা না হলে বাইরে থেকে বিনিয়োগ আসবে না। বিনিয়োগ না এলে উন্নয়নের ধারা ধরে রাখা যাবে না। এসব কারণে ২০১২ সাল থেকে সম্পর্কটাকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় নিয়ে গেছি। এখন পার্টনারশিপ, ইকোনমিক, সিকিউরিটি ডায়ালগসহ আরও কিছু ডায়ালগ হয়। এতে সম্পর্কটা একটি কাঠামোতে আসে। তবে এই কাঠামো খুব শক্তিশালী হয়েছে, তা মনে করি না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে হলে আমাদের এগুলোতে আরও মনোযোগী হতে হবে।
বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মার্কিন ‘স্যাংশন’-এর আওতায় এসেছেন। আমি মনে করি, এটি খুব বড় বিষয় নয়। কারণ আমাদের সম্পর্ক বহুমুখী ও কয়েক স্তরের। আলোচনা ও পারস্পরিকভাবে প্রত্যাশা কী– এটি বুঝে আমরা যদি এ সমস্যার সমাধান করি, তাহলে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যা যত বড়ই হোক সমাধান পাওয়াটা সহজ।
পরস্পরকে আমরা যদি নেতিবাচকভাবে দেখি– আমাকে ও শাস্তি দিচ্ছে, ওকে আমিও শাস্তি দিব, তা ভালো কিছু বয়ে আনবে না। সে জায়গায় না যাওয়াই ভালো। মনে রাখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক স্থানে আমাদের পাশে আছে। গ্লোবাল পিস কিপিংয়ে সহযোগিতা করেছে। নেভি ডেভেলপমেন্টের জন্য নেভি শিপ দিয়েছে, পুরো কোস্টাল এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার দিয়েছে, কৃষিতে গুটি ইউরিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের কাজে আমাদের সহযোগিতা করেছে। করোনাকালে সবচেয়ে বেশি টিকা দিয়েছে। সিডরের সময় দ্রুত এসে আমাদের সহযোগিতা করেছে, জীবন বাঁচিয়েছে। আমি যদি বড় বিষয়গুলো দেখি, তাহলে এসব ছোট বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো।
মনে রাখতে হবে, বন্ধুর সঙ্গেও কিন্তু আত্মমর্যাদার একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্বার্থটা বড় জিনিস। এখানে কোনো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই। আমাকে বাস্তব অবস্থার আলোকে কাজটি করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের উন্নয়নের শক্তিশালী অংশীদার। এটি শক্তিশালী করার জন্য অনেক কাঠামো তৈরি হয়েছে। এই কাঠামোগুলো ভবিষ্যতে সম্পর্ক বিন্যাসে ব্যবহার করা উচিত। দ্বিতীয়ত, অনেক প্রত্যাশার জায়গা রয়েছে। ব্লু ইকোনমি, জ্বালানি নিরাপত্তা, ডিজিটাল ইকোনমি ইত্যাদি বিষয়ে সক্ষমতা, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আর্থিক সহায়তা– এসব বিষয় নিয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে পারি। আর ভাবমূর্তির দিক থেকে আমার একটা ভালো বন্ধু আছে, শক্তিশালী বন্ধু আছে– বিপদে যার সাহায্য পেতে পারি। কূটনীতির আলোকে এ রকম ইতিবাচক সম্পর্ক থাকলে আমাদের মতো দেশের জন্যও ভালো।
এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার কী, তারা কী পছন্দ করে– তা কিন্তু বলে দিয়েছে। আর সেটা হলো গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রের মধ্যে আছে নির্বাচন, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, শ্রম অধিকারসহ সব ধরনের অধিকার। গণতন্ত্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আমেরিকা দেখিয়েছে, যেখানে সব ধরনের অধিকারের কথা আছে। এখন বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিতে হবে। আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে–দ্বিপক্ষীয় হোক কিংবা বহুপক্ষীয়–সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চাই, তাহলে এটি আমাদের করতে হবে।
এম. হুমায়ুন কবির: আমেরিকায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
