ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

প্রসাধনী খাতে বিপুল সম্ভাবনা আছে নানা চ্যালেঞ্জও

প্রসাধনী খাতে বিপুল সম্ভাবনা আছে নানা চ্যালেঞ্জও

কোলাজ

জসিম উদ্দিন বাদল

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৩ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০৮:২০

কমবেশি সবাই প্রসাধনী ব্যবহার করে থাকেন। ফলে জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে দিন দিন বাড়ছে এসব পণ্যের চাহিদা। বাড়তি এই চাহিদা মেটাতে প্রসাধনী খাতে মানসম্মত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। আগে থেকেই কিছু প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদন করলেও মানোন্নয়নে তাদের নজর ছিল কম। ফলে ক্রেতারা ঝুঁকে পড়েন বিদেশি ব্র্যান্ডের দিকে। এ সুযোগে নকল ও ভেজালের ছড়াছড়ি বেড়েছে মাত্রাহীন। বাজার দখল করে নিয়েছে চোরাকারবারিরা। আমদানির আড়ালে হচ্ছে অর্থ পাচার। সরকারও হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব। এ পরিস্থিতিতে প্রসাধনি পণ্যের চাহিদা ও সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশীয় উদ্যোক্তারা অনেকেই বড় আকারে বিনিয়োগ করছেন।

উন্নত গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় মানসম্মত পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। এসব পণ্যে ক্রেতাদেরও আগ্রহ বাড়ছে। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, সামনে এগোতে হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে। বিশেষ করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে আইনগত প্রতিবন্ধকতা। কাঁচামাল আমদানিতে আছে শুল্ক বাধা। 

উদ্যোক্তাদের দাবি, প্রসাধনীকে উদীয়মান শিল্প বিবেচনা করে নির্দিষ্ট মেয়াদে উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে শুল্ক অব্যাহতি ও কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দিতে হবে। ভ্যাট শুধু বিক্রি পর্যায়ে ৫ শতাংশ রেখে অব্যাহতি দিতে হবে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে। কালার কসমেটিকস শুল্কায়নের ক্ষেত্রে নেট ওয়েটের পরিবর্তে গ্রস ওয়েট বিবেচনায় শুল্কায়ন করতে হবে। তাতে উৎসাহিত হবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। গড়ে উঠবে নতুন কারখানা। একই সঙ্গে তৈরি হবে পশ্চাৎসংযোগ শিল্প।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারাও বলছেন, বিনিয়োগ পরিবেশ ঠিক করে নীতিসহায়তা দিলে এ খাত অনেকদূর এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে আমদানি বন্ধ হবে। তাতে সাশ্রয় হবে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। উৎপাদনকারীদের জবাবদিহির মধ্যে রেখে নিশ্চিত করা সম্ভব মানসম্মত পণ্যের সরবরাহ। সুযোগ বাড়বে নতুন কর্মসংস্থানের। এভাবে রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রসাধনী খাত হতে পারে তৈরি পোশাকের বিকল্প।

বাজারের আকার ও প্রবৃদ্ধি 
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্যবসা ও অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যালাইড মার্কেট রিসার্চের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বিশ্বে প্রসাধনী বাজারের আকার ছিল ৪২৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। পরবর্তী দশকে এর আকার বেড়ে হতে পারে দ্বিগুণ। অর্থাৎ ২০৩২ সালে এ বাজার হবে ৮৬৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। 

বাংলাদেশের বাজার একেবারে ছোট নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্সের ভাষ্যমতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রসাধনীর বাজার ছিল ১২৩ কোটি ডলারের, যা বেড়ে ২০২৭ সালে পৌঁছাবে ২১২ কোটি ডলারে। সংস্থাটি বলেছে, ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের বাজার ৮ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়বে। বাংলাদেশে প্রসাধনী উৎপাদনের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আসে ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, উগান্ডাসহ কয়েকটি দেশ থেকে। এ ছাড়া কিছু বড় প্রতিষ্ঠান জার্মানি, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। মোট কাঁচামাল আমদানির ৯৫ শতাংশই আনে ইউনিলিভার, কেয়া, লিলি, অ্যারোমেটিক, স্কয়ার ও কোহিনুর কেমিক্যাল।

প্রসাধনীর বাজার নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনেরও একটি প্রতিবেদন রয়েছে। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, দেশে কালার কসমেটিকস পণ্যের চাহিদা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার এবং স্কিনকেয়ার পণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার। দুই ধরনের পণ্য মিলিয়ে মোট প্রসাধনী খাতের বাজারের আকার প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার। তবে এর বড় অংশই আমদানি হয় চোরাকারবারিদের মাধ্যমে, যার পরিমাণ ২৪ হাজার কোটি টাকার মতো।

এর বাইরেও বড় একটা অংশ রয়েছে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের কসমেটিকসের দখলে। এসব পণ্য ব্যবহারে ত্বকে দাগ পড়া, মাথার চুল পড়ে যাওয়া, চামড়া বিকৃত হওয়া, বন্ধ্যত্বসহ লিভার ও কিডনির নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী সমকালকে বলেন, প্রসাধনী খাত ব্যাপকভাবে আমদানি নির্ভর। এসব পণ্যের রাসায়নিকের ৯০ শতাংশই আমদানি হয়। এ পরিস্থিতিতে দেশে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতের কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর ছাড়সহ বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, স্থানীয় শিল্পের প্রসার হলে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে। বড় হবে কর্মসংস্থানের পরিধি।  আমদানি কমলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মাহফুজ কবীর বলেন, দেশে উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন হলে তা শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারও রোধ করবে। পাশাপাশি অর্থনীতির জন্য হবে ইতিবাচক। কর্মসংস্থান হবে লাখ লাখ মানুষের। 

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) সহসভাপতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক এম এস সিদ্দিকী মনে করেন, আমদানিনির্ভরতা কমাতে স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। সে জন্য প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা দিতে হবে। এতে নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।
শুল্ক-কর আমদানির চেয়ে উৎপাদনে বেশি

ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, আমদানি করা প্রতি পিস লিপস্টিকের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২ টাকা ৯০ পয়সা। বিপরীতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতি পিসের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১৮ টাকা ৬৮ পয়সা। এ ছাড়া সাধারণ মানের এক পিস লিপস্টিক আমদানিতে রাজস্ব দিতে হয় ১৩ টাকা ৬৪ পয়সা। আর স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতি পিসে দিতে হয় ৪৯ টাকা ৪৯ পয়সা। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, প্রসাধনী পণ্যে মোট শুল্ক-কর একেবারে কম নয়। ক্রিম আমদানিতে ১৫৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, ফেসওয়াশ ও সাবানে ১২৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, শ্যাম্পু ও হেয়ার কালারে ১৮৩ দশমিক ৪০ শতাংশ শুল্ক-কর রয়েছে। শুল্ক-কর বেশি থাকায় কিছু আমদানিকারক বিভিন্নভাবে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পণ্য খালাস করে নেয়।

এ খাতে বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রিমার্ক এইচবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল আম্বিয়া বলেন, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিদেশি প্রসাধনী আনা হচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এ খাতে দ্রুত বিকাশ ঘটবে।

সম্প্রতি একটি কর্মশালায় যোগ দিতে বাংলাদেশে আসেন থাইল্যান্ডের কসমেটোলজিস্ট ড. সাকুন মাংগুত। বাংলাদেশের প্রসাধনীবিষয়ক একটি প্রবন্ধে তিনি বলেন, শুধু উৎপাদন নয়, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকেও নজর দেওয়া উচিত। পণ্যের মানোন্নয়ন ও ভোক্তার আস্থা অর্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা, পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তিনি।

বিনিয়োগে বাধা আইনি জটিলতা
দীর্ঘদিন ধরে প্রসাধনী খাতের ব্যবসায়ীরা বলে আসছিলেন, চাহিদা ও ব্যবহারের দিক থেকে ওষুধ এবং প্রসাধনী সম্পূর্ণ আলাদা দুটি পণ্য। একটি ব্যবহার হয় শরীরে সৌন্দর্য বাড়াতে। অন্যটি জীবন রক্ষার্থে। প্রসাধনী বিক্রিতে ফার্মাসিস্টের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধ বিক্রি করা যায় না। তাই পণ্য দুটিকে একই আইনের আওতায় না এনে আলাদা আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে শুধু কসমেটিকস শিল্পের উৎকর্ষই বাধাগ্রস্ত হবে না, এই শিল্পের ব্যয়ও বাড়াবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমবে। পণ্যের দাম বেড়ে যাবে।

কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত না করে গত বছর এ সম্পর্কিত আইনটি পাস করে। এতে বেশ বিপাকে পড়েন এ খাতের উদ্যোক্তারা। নতুন এই আইনে প্রসাধনীর মান নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরিবর্তে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

মিল্লাত কেমিক্যাল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহফুজ জামান বলেন, দুটি পণ্য আলাদা প্রয়োজনে ব্যবহার হয়। কিন্তু দুটিকে একই আইনের অন্তর্ভুক্ত করায় অনেকেই এ ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আইনের বেড়াজালে বিনিয়োগকারীরা হুমকিতে পড়ছেন। মন্থর হয়ে গেছে নতুন বিনিয়োগের গতি। আইনটি পর্যালোচনা করা দরকার।

রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার তাগিদ
বিশ্লেষকদের মতে, এলডিসি উত্তরণে বাংলাদেশকে অবশ্যই রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনতে হবে। পোশাকের বিকল্প পণ্য রপ্তানি বাড়াতে হবে। প্রসাধনী খাতের উদ্যোক্তারা মনে করেন, সরকারের সার্বিক সহায়তা পেলে এ খাত স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। আইবিএফবির সহসভাপতি এম এস সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ডলারের প্রসাধনী ও ত্বকের যত্নের পণ্য রপ্তানি হয়। বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ালে এবং বন্ড সুবিধা দিলে আগামী দুই বছরের মধ্যে রপ্তানি ৫০ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। কারণ পোশাকের চেয়ে এটাতে মূল্য সংযোজন বেশি। 

যেসব সহায়তা চান উদ্যোক্তারা
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, প্রতি বছর বাজেটের আগে সরকার ব্যবসায়ীদের দাবি-দাওয়ার কথা শোনে। কিন্তু বাজেটে তা প্রতিফলিত হয় না। বরং কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করে স্থানীয় শিল্পে করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ খাতের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিনকেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশের (এএসবিএমইবি) সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন সমকালকে বলেন, ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহার করে ক্রেতারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করার জন্য স্থানীয় শিল্পকে শুল্ক-কর ছাড়সহ নীতিসহায়তা দিতে হবে। ঠিক করতে হবে বিনিয়োগের পরিবেশ। তবে মানহীন পণ্যের বাজার ঠেকাতে না পারলে বিনিয়োগ হুমকিতে পড়বে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, ভেজালের বিরুদ্ধে অধিদপ্তর সোচ্চার রয়েছে। তবে দেশে বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন হলে আমদানি কমবে। ভেজালও কমবে।

আরও পড়ুন

×