গ্রামের খেটে-খাওয়া দরিদ্র মানুষের ভাগ্য বদলের অন্যতম হাতিয়ার সঠিক শিক্ষা। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের ভাগ্য তথা দেশ ও জাতির উন্নয়ন করা সম্ভব।

সঠিক দিকনির্দেশনা আর সুযোগ-সুবিধার অভাবে ঝরে পড়ছে গ্রামের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে এসে পিছিয়ে পড়ে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। মেধার যথাযথ প্রয়োগ তারা করতে পারছে না। পিছিয়ে পড়ছে প্রতিযোগিতার দৌড়ে। বিষয়টি তিনি অনুধাবন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন অবস্থায়।

আর্থিক অসচ্ছলতা আর পারিবারিক জটিলতার কারণে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সর্বক্ষেত্রে। মেয়েদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও কঠিন। ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কোচিংয়ে পাঠাতে একদম নারাজ অভিভাবকরা। অথচ গ্রামের শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো নির্দেশনা দিতে পারলে তারাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারে।

নির্দেশনার অভাবে বঞ্চিত এসব শিক্ষার্থীদের সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার পন্থা হিসেবে মাহিন মতিন বেছে নেন ডিভিডির মাধ্যমে পাঠদান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, প্রস্তুতিসহ বিষয়ভিত্তিক নির্দেশনা নিয়ে তিনি তৈরি করেন ডিভিডি এবং তা পেঁৗছে দেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামে। উদ্যোগের শুরু ছিল ২০১০ সালে মাহিন মতিনের জন্মস্থান চাঁদপুরে নিজের উপজেলা হাইমচরে। এ উদ্যোগে সহযোগিতা করেন জাপানি বন্ধু আতসু সি। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকে ইন্টার্নশিপ করার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। দু'জন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন 'ই-এডুকেশন এনপিও'। মাহিন জানান, তিনি প্রথমে তার আইডিয়া ও ইচ্ছার কথা তার জাপানি বন্ধুকে জানান। বিষয়টি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে তার জাপানি বন্ধু আতসু সিকে। পরে তারা কাজ শুরু করেন।



হাইমচর কলেজের সামনে মাহিন মতিন ও তার জাপানি বন্ধু ছয়টি ল্যাপটপের সাহায্যে শুরু করেন ডিভিডির মাধ্যমে পাঠদান। প্রথম বছর ৪৫ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হন। ওই বছর তিন ছাত্র ঢাবি, কুবি ও রাবিতে ভর্তির সুযোগ পান। ৩৯ জন সুযোগ পান চাঁদপুর সরকারি কলেজে। টিউশনের টাকা দিয়ে এলাকায় গিয়ে পড়াশোনা তদারক করেন। ডিভিডি বিতরণ করেন। প্রথম বছরে সফলতা পেলে মাহিন মতিন আরও অনুপ্রাণিত হন। বিগত বছরগুলোর লেকচার ভিডিওগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। বিভিন্ন অ্যানিমেশন ও গ্রাফিক্স যোগ করা হয়।

প্রতি বছর তাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সফলতার হারও দারুণ। বিগত ছয় বছরে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন ৪০ জন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। এ বছর চাঁদপুর জেলায় ৪০০ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়েছেন।

২০১৪ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তার পাশাপাশি স্কুল পর্যায়ে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির গণিত এবং ইংরেজিকে সহজভাবে গ্রামের শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নেন। বিভিন্ন জেলার কমপক্ষে ৪০টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের এ সুবিধা দেওয়া হয়। রাজধানীর নামকরা স্কুলের শিক্ষকদের ক্লাস লেকচার ভিডিও করে সেগুলোকে গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিভিডি আকারে প্রদান করেন। এ উদ্যোগে সার্বিক সহায়তা প্রদান করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

একই বছর ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সেকেন্ডারি এডুকেশন অ্যান্ড কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় পাঁচ জেলার ৫০টি গ্রামের স্কুলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়কে সহজ করে তুলে ধরার জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে ইনোভেশন ফান্ড পান মাহিন মতিন। এই প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের জন্য বায়োলজি, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বিষয়ের জন্য লেকচার ভিডিও তৈরি করেন এবং অভাবনীয়ভাবে সাফল্য পান।

পরে ২০১৫ সালে Bangladesh Massive open online course (www.bmooc.net) নামক একটি ওয়েবসাইট খোলেন মহিন মাতিন। যার মাধ্যমে অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার নিয়ম-কানুনসহ প্রিপারেশন লেকচার রয়েছে। একই সঙ্গে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিষয়ভিত্তিক অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির গণিত এবং ইংরেজিসহ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য বায়োলজি, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বিষয়ের জন্য লেকচার ভিডিও। যে কেউ যে কোনো জায়গা থেকে বিনামূল্যে লেকচারগুলো ডাউনলোড করতে পারেন। রয়েছে মডেল টেস্ট দেওয়ার ব্যবস্থা।

তাদের রয়েছে অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের কমেন্টের মাধ্যমে যে কোনো বিষয় জানাতে পারবেন। তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সব ধরনের সহায়তা করা হয়।

তাদের এ কার্যক্রম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যান্য দেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে মিয়ানমার, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, নেপাল, জর্ডান, ফিলিস্তিন, রুয়ান্ডা, হাঙ্গেরিসহ ১২টি দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করছে ভিডিও লেকচার। সেখানে মহিন মাতিন অ্যাডভাইজর ও মোটিভেশন স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছেন।

সম্প্রতি মাহিন মতিনের ব্যাকবোন ফাউন্ডেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশের প্রথম 'আন্তর্জাতিক ডিজিটাল শিক্ষা সম্মেলন'। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, জাপানের অ্যাম্বাসাডর মাসাতো ওয়াতানাবে, জাপানের হিতশোবিশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইয়োনেকরা, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আবু ইউসুফসহ অনেকে। এরই ধারাবাহিকতায় অর্জন করেছেন দেশে ও দেশের বাইরে অসংখ্য পুরস্কার। ২০১২ সালে ডেল কোম্পানি থেকে পান 'ডেল সোস্যাল ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড'। ২০১৩ সালে পান চীনের লেনোভো ইন্টারন্যাশন্যাল কর্তৃক 'লেনোভো ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড'। ২০১৪ সালে জাপানের হিতোসুবাসি ইউনিভার্সিটি কর্তৃক ই-লার্নিং অ্যাওয়ার্ড এবং ইউনিভার্সিটি অব টোকিও কর্তৃক টাকেডা ইয়ং এন্ট্রাপ্রেনারশিপ অ্যাওয়ার্ড পজতেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাহিন মতিন জানান, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি লাইফ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হবে, সেই সঙ্গে সারা দেশে তাদের এই শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রাসারণ করা হবে।


মন্তব্য করুন