
লিটল ইন্ডিয়া, অরচার্ড রোডের দোকানগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে যেত একেকদিন। উইকেন্ডগুলোতে যখন তারা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে ফিরত ততক্ষণে 'যে শহর কখনও ঘুমায় না' সেই শহরেরও প্রায় সব মানুষ ঘুমিয়ে পড়ত, শুধু স্ট্রিট ল্যাম্প আর সশব্দে ছুটে চলা বাসের তর্জন যেন প্রাণের স্পন্দন জানান দিত।
বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার পরও তাদের তর্কের শেষ হতো না। কার জন্য কোন গিফটটি ভালো হবে? বর্ষার পছন্দে টিপ্পনী কাটত সোহেল। তার বদলে তার কপালেও জুটত টিপ্পনী। তবে কম দেখে জিনিস কেনার অনুযোগে বর্ষা প্রায়ই সোহেলকে অভিযুক্ত করত। এ নিয়ে সোহেল কোনো তর্কে জড়ায় না।
তাদের প্লেন হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার পরে ঘণ্টা পাঁচেক চলে গেছে। সোহেল আর বর্ষা এখন বাসায় এসে কাপড়চোপড় ছেড়ে তাদের লাগেজ নিয়ে বসেছে। বাবা বলে ওঠেন বর্ষাকে, 'মা এখনই এগুলো নিয়ে বসছ কেন? আগে খেয়ে নাও, রেস্ট নাও। কাল সকালে না হয় এসব নিয়ে বসা যাবে।'
বর্ষা বাবার কথায় কান না দিয়ে তার বড় লাগেজটা খুলতে যাবে, ঠিক সে সময় সোহেল কিছু একটা বলতে গিয়েও তানিয়ার দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। তানিয়ার চোখে স্পষ্ট কৌতূহল। সে হুমড়ি খেয়ে নেমে মেঝেতে গিয়ে বর্ষার পাশে বসে।
বর্ষা একটা সোনার আংটি বের করে মার হাতে দেয়। মা আংটিটা নিয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করেন, 'মা, এর ওজন কত?'
'চার আনা মা।'
'চার আনা! আমি ভেবেছিলাম এটা বুঝি ছয় আনা।' একটু মৃদু গলায় মা বলে ওঠেন। একটু থেমে তিনি আবার বললেন, 'তা এটা কয় ক্যারেট মা?'
'এইট ক্যারেট।'
'এইট ক্যারেট? আমি তো মনে করেছিলাম সিঙ্গাপুরে আঠারো ক্যারেটের নিচে সোনাই পাওয়া যায় না। তা হোক তবুও তো সিঙ্গাপুরের জিনিস।' মা হেসে বলেন। তবুও একটু যেন ম্রিয়মাণ লাগে মায়ের হাসিটা।
'বাবা নাও, তোমার ঘড়ি।' সোহেল বাবাকে ঘড়িটা দেয়। বাবা জিজ্ঞেস করেন, 'এটা কি সিঙ্গাপুরেই তৈরি?'
'না বাবা, এটা মালয়েশিয়ায় তৈরি।' নিচু গলায় সোহেল বলে।
'আরে মালয়েশিয়ার জিনিসও তো আমাদের মতো প্রায় একই। তা তুই এত টাকা খরচ না করলেই ভালো করতি বাবা।'
বর্ষা এবার দাদিমার হাতে একটা পার্স তুলে দেয়, 'ভালো, খুব ভালো, তোদের পার্সটা তো খুব সুন্দর, তা বোন আমি তো আর মার্কেটে যাই না। এক পা তো কবরেই গেছে। এখন তো খালি আল্লাহ আল্লাহ করি রাতদিন। ওই দেশে মুসলমান নাই? একটা ধর্মের বই আনলেই পারতি।'
কেউ তার কথার জবাব দেওয়ার আগেই সুমন লাগেজের ভেতরে বাইনোকুলার দেখিয়ে বলে, 'ভাবী, এটা বোধহয় আমার?'
'হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটা তোমার।'
'ওহ ভাবি, তোমরা যে কী না! বাবা তো আমার এবারের জন্মদিনেই একটা সুন্দর বাইনোকুলার দিয়েছেন। এইটা নিশ্চয়ই ভাইয়ার কাণ্ড। ভাইয়া যে কবে আমার পছন্দটা বুঝবে।' সোহেল আর বর্ষা চোখাচোখি করে, কেউ কিছু বলে না।
তানিয়া একটা গাঢ় সবুজ শাড়ি বের করে বলে, 'ভাবী, এটা কি আমার শাড়ি?'
'হ্যাঁ, ওটা তোমারই। তোমার ভাইয়ার পছন্দ।'
'নাহ ভাইয়া, তোমার পছন্দ সব সময়ই সুন্দর কিন্তু তুমি বোধহয় শাড়ি কেনার সময় আমার গায়ের রঙ ভুলে গিয়েছিলে। এই শাড়ি আমার কালারের সঙ্গে ম্যাচ করবে বলো?'
সোহেল বোকা বোকা চোখে বর্ষার দিকে তাকায়। বর্ষা তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নেয়।
'এই শুক্কুর, তোর চাবির রিংটা নে ধর।' নিরাপদ স্বরে সোহেল বাড়ির কাজের ছেলে শুক্কুরের দিকে চাবির রিংটা ছুড়ে দেয়।
শুক্কুর ক্রিকেট ফিল্ডারের মতো করে রিংটা লুফে নেয়। সে রুমের এক কোণে মেঝেতে বসে ছিল। সে সোহেলের কাছে এসে বলে, 'ভাইজান, এইডা কি আমার লাইজ্ঞা আনছেন?'
'হ্যাঁরে গাধা, তোর জন্য।'
'আমার?'
'হ্যাঁ, তোর। তোর হইছেটা কি গাধা?'
শুক্কুর সোহেলের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। সোহেল আর বর্ষা শুক্কুরের ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা রিংটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারা ভাবতে থাকে, সেন্টের অংকে রিংটা সবচেয়ে দামি হলেও ওটা কিনতে তাদের কোনো ডলার খরচ করতে হয়নি।
হসহযোগী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
মন্তব্য করুন