- কালের খেয়া
- মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল
কালের খেয়া
তুমুল গাঢ় সমাচার
মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল
ধারাবাহিক

[গত সংখ্যার পর]
লিবারেল মিলের আলোচনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছন্দপতন ঘটেছে যখন উপনিবেশ শাসনের ক্ষেত্রে 'প্রতিনিধিত্বশীল' সরকার-ব্যবস্থার বিপরীতে সরাসরি 'স্বৈরাচারী' (ডেসপটিজম) শাসনের সপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়া হয়েছে। ব্রিটেনে বা ইউরোপে চলবে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার-ব্যবস্থা, কিন্তু ভারতবর্ষে বা অন্যান্য উপনিবেশগুলোয় চলবে অ-প্রতিনিধিত্বশীল 'স্বৈরাচারী' ব্যবস্থা- এই দ্বিত্বতা মিলের রাষ্ট্রচিন্তার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে 'স্বৈরাচারী' শাসনের যুক্তি নির্মাণের জন্য মিলকে এক সময় ওরিয়েন্টাল ডেসপটিজমের তত্ত্বকেও আশ্রয় করতে হয়েছে। এখানে মিলের যুক্তি ছিল অনেকটা পিতা জেমস মিলের (এবং হেগেলের) অনুগামী। মিল যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন যে, যেহেতু ভারতবর্ষীয়রা ব্রিটিশপূর্ব যুগে 'স্বৈরাচারী' শাসন-ব্যবস্থার অধীনে ছিল, সেহেতু ইংরেজরা নতুন করে কোনো স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম করেনি সেখানে, বরং আলোকিত এক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতবর্ষীয়দের 'সভ্য করাই' এই শাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই যুক্তি-তর্কের একটি আশু রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। রাজকর্ম পরিচালনায় জবরদস্তি বা শাসিতের জন্য অনিষ্টকর কোনো নীতিমালা (যাকে মিল বলেছেন 'হার্ম প্রিন্সিপল') প্রয়োগের সম্ভাব্যতা নিয়ে নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব এতে করে এড়িয়ে যাওয়া হলো। সাধারণভাবে মিলের নৈয়ায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে, কোনো সভ্য জাতি বা জনগণের ওপরে অনিষ্টকর বা জবরদস্তির নীতি প্রয়োগ করা যাবে না। তবে যেসব জাতি বা জনগোষ্ঠী এখনও উন্নয়নের শৈশব-স্তরে রয়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে-তাদের সম্মতি বা অসম্মতির অপেক্ষা না করেই জবরদস্তির নীতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিশেষত যদি ইতিমধ্যেই তাদের স্বৈরাচারী শাসনে থাকার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে থাকে প্রাগ-উপনিবেশ পর্বে। মিলের এই চতুর নীতিটি সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের পক্ষে একটি জোরালো যুক্তি হিসেবে এখনও ব্যবহূত হয়ে থাকে। উদাহরণত, ১৮৫৯ সালের 'এ ফিউ রিমার্কস অন নন-ইন্টারভেনশন' প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, সভ্য জাতির ক্ষেত্রে 'আমাদের ধ্যান-ধারণা আদর্শ অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে সামান্যই যুক্তি রয়েছে', কিন্তু এ কথা খাটে না 'সভ্যতার নিম্নতর স্তরে থাকা জনগোষ্ঠীর বেলায়'। ওদের ক্ষেত্রে 'প্রথাগত আন্তর্জাতিক ন্যায়-নীতি খাটে না'; কেননা এসব ন্যায়-নীতির প্রয়োগ তো পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে হবার কথা, কিন্তু 'বর্বর জনগোষ্ঠী কখনও সমান ন্যায়-নীতির প্রয়োগের রীতিতে বিশ্বাস করে না বা করবে বলে এমনটা আস্থা করা যায় না। তাদের মন-মানসিকতা সে রকম প্রচেষ্টা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনুকূল নয়।' ফলে তাদের নিজেদের স্বার্থেই 'তাদেরকে পরাভূত করতে হবে এবং বিদেশি শক্তির অধীনে রেখে দিতে হবে।' এর মধ্যে সাম্প্রতিক কালের আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরানে হস্তক্ষেপের একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক যুক্তির খসড়া তৈরি হতে দেখি। মিল অবশ্য এ ধরনের হস্তক্ষেপকে এক ধরনের 'পেডাগজিক্যাল হস্তক্ষেপ' হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, যেমনটা হয় গুরুকুলে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্কে। ছাত্রের ভালোর জন্যই তাকে নিয়ন্ত্রণের কড়া শাসনে ও শৃঙ্খলায় বাঁধতে হয়। একই যুক্তির বলেই মিল 'প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকোনমিতে' দেখিয়েছেন যে, কেবলমাত্র সভ্য জাতির ক্ষেত্রেই ফ্রি-মার্কেট ইকোনমি ও রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট প্রযোজ্য; অসভ্য জাতির ক্ষেত্রে অর্থনীতিতেও চলতে পারে ফ্রি-মার্কেট ইকোনমির ব্যত্যয় এবং রাজনৈতিকভাবে স্বৈরাচারী শাসন-ব্যবস্থার প্রবর্তন।
তবে উপনিবেশের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের প্রয়োগ করতে গিয়ে মিল কিছুটা নমনীয় ছিলেন নেটিভদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার নিজস্বতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে। দার্শনিক কোম্তের সঙ্গে চিঠিপত্রে তিনি একদিকে সমালোচনা করেছেন ভারতবর্ষের রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রথা সমূহের, যার মধ্যে রয়েছে শিশু হত্যা, ঠগি-বৃত্তি, সতীদাহ প্রথা, তুকতাক বিদ্যা, পর্দা প্রথা ইত্যাদি। অন্যদিকে মিল বুঝেছিলেন যে, এসব প্রথা বিলয়ের জন্য শুধু সহায়ক আইন জারি করাই যথেষ্ট নয়; এর জন্য ক্রমান্বয়ে সংস্কার আনতে হবে নেটিভ সমাজবলয়ে। এ ক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথম উদাহরণটি হচ্ছে, পূর্ব উল্লিখিত এংলিসিস্ট বনাম ওরিয়েন্টলিস্ট বিতর্ক। এই বিতর্কে যদিও মিল শেষ পর্যন্ত ম্যাকলে সাহেবের সঙ্গে সুর মেলান 'বাদামি সাহেব' তৈরি করার প্রকল্পে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু সংযোজন ছিল তার। ১৮৩৬ সালের 'রিসেন্ট চেইঞ্জেস ইন নেটিভ এডুকেশন' ডিসপ্যাচের খসড়ায় মিল প্রস্তাব করেন যে, (ক) এই নেটিভ সাহেবদের প্রাচ্য ভাষা ও প্রাচ্যবিদ্যায় প্রশিক্ষিত হতে হবে; (খ) ভারতবর্ষের ক্লাসিক্যাল ভাষাসমূহ যথা সংস্কৃত, ফার্সি ও আরবি ভাষা জানা এবং হিন্দু-মুসলমান আইন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকাটা সঠিক বিচারকার্য পরিচালনার জন্যও অত্যাবশ্যক। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে, ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করা নিয়ে। এখানে কান্টের অনুগামী হয়েছেন মিল। কান্ট বলেছিলেন, 'আমি যুক্তি থেকে পিছু হটে বিশ্বাসকে কিছুটা জায়গা করে দিতে বাধ্য হলাম'। যুক্তিবাদ সর্বত্র খাটে না, যুক্তিবাদেরও সীমা রয়েছে, এবং যদিও অযৌক্তিক অনেক ক্ষতিকর সামাজিক বিশ্বাস-সংস্কার রয়ে গেছে যার মূল উৎপাটন করা জরুরি, তবুও এসব বিশ্বাসের একটা গুরুত্ব রয়ে গেছে সাধারণ জনজীবনে। ১৮৫৮ সালের পিটিশনে তাই মিল জোরেশোরে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের জনগণের মধ্যে নানাবিধ 'ধর্মীয় চর্চার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করার যে সিদ্ধান্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অদ্যাবধি নিয়ে এসেছে' (অবশ্যই কতিপয় ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিয়ে- যেগুলো মানবতার জন্য স্পষ্টত অত্যন্ত গর্হিতকর) তা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত রাখা দরকার।
মিলের কিছু কিছু লেখায় প্রকাশ্য বর্ণবাদেরও ছায়াপাত ঘটেছে। নেটিভ আমেরিকানদের তিনি কুঁড়ে বলেছেন; চীনাদের মধ্যে তিনি পেয়েছেন দূরদর্শিতার অভাব; ভারতবর্ষীয় ও চীনাদের মধ্যে সম্পদ-আহরণের কোনো তাগিদ দেখেননি। তবে এ ক্ষেত্রেও বলতে হয় যে, আপাতদৃষ্টিতে বর্ণবাদী কথাবার্তা সত্ত্বেও মিল স্বীকার করে গেছেন যে, এসব জাতিগত পার্থক্য মূলত উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে না ওঠার কারণেই সৃষ্ট হয়েছে। এসব পার্থক্য কোনো নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যজনিত নয়। উদাহরণত তিনি দেখিয়েছেন, নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে চীনে, ভারতবর্ষে, এমনকি য়ুরোপের অপেক্ষাকৃত স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় (যথা রাশিয়া, তুরস্ক, স্পেন, আয়ারল্যান্ড) বিরাজ করছে এমন ধরনের ভূমিসত্ত্ব আইন যার মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- ফলে তাদের মধ্যে সম্পদ-আহরণের স্পৃহা আসবে কোথা থেকে? ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তিনি কর্নওয়ালিশের জমিদারি আইনের সমালোচক ছিলেন এবং সরাসরি প্রজার কাছে রায়তওয়ারি স্বত্ব দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। এ ক্ষেত্রে মিল ও বঙ্কিমের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রত্যাশিত সদৃশতা ছিল।
তারপরও সব ছাপিয়ে মিলের দ্বিত্ব-অবস্থানের দিকটিই বড় হয়ে ওঠে। সভ্য ইংরেজ জাতি স্বৈরাচারী পদ্ধতি অবলম্বন করে পদানত করে হলেও অসভ্য ভারতবর্ষকে উন্নত (নেটিভদের ভালোর জন্যই) করবে- এর সপক্ষে মিল আমৃত্যু অবিচল থেকে গেছেন। ভারতবর্ষের লোকেরা নিজেরা নিজেদের মতো করে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার-ব্যবস্থা দাঁড় করাবে ব্রিটিশ রাজশক্তির সহায়তা ছাড়াই, এটি মিলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা মনে হয়নি। এ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য কোনো দিন-ক্ষণের আভাস দিতে রাজি হননি মিল। বরং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির 'প্রত্যক্ষ শাসন' আরও দীর্ঘকালের জন্য অব্যাহত থাকুক, এর পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন তিনি। য়ুরোপের প্রাগ্রসর চিন্তাবিদের মধ্যে এই যে দ্বিত্বতা আমরা দেখতে পাই তা কোনো সাধারণ মাপের দ্বিধা, দোলাচল বা দ্বন্দ্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। একেই আমরা প্রবন্ধের শুরুতে 'সত্তার বিভক্তি' বলেছি যখন সত্তা উদার ও অনুদার চিন্তার বলয়ে বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। শাসক ও শাসিতের জন্য তৈরি হয় আলাদা নিয়ম-কানুন। যে রীতি ইংল্যান্ডে চলে সে যুক্তি ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে চলে না। মিলের সত্তার এই দ্বৈততা ইউরোপীয় আধুনিকতারই অন্তর্গত দ্বৈততার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই দ্বৈততা 'আমাদের ও তাদের' এ দুই সাংস্কৃতিক ভুবনের মধ্যে একাধারে আধুনিক উদার ও ঔপনিবেশিক অনুদার নির্ভরশীলতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি করে।
২. বঙ্কিমচন্দ্রের মিল
মিলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বঙ্কিম যথার্থই শোকাভিভূত হয়েছিলেন : 'মিলের মৃত্যু হইয়াছে! আমরা কখন তাঁহাকে চক্ষে দেখি নাই; তিনি কখন বঙ্গদর্শনের পরিচয় গ্রহণ করেন নাই। তথাপি আমাদিগের মনে হইতেছে যেন আমাদিগের কোন পরম আত্মীয়ের সহিত চির বিচ্ছেদ হইয়াছে।' মিলের কীর্তির উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি জোর দিয়েছেন এথিকস ও ইকোনমিক্স বিষয়ে তার অবদানের ওপরে : 'মিল অতি সূক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন নৈয়ায়িক ছিলেন। তাঁহার কৃত ইংরেজি ন্যায়শাস্ত্র এবং অর্থব্যবহারশাস্ত্র তাহার প্রধানকীর্তি। ইহাতে তিনি যে কোন নূতন কথার উদ্ভাবন করিয়াছেন তাহা নহে কিন্তু এতৎসংক্রান্ত সমুদয় কথা এমন সুশৃঙ্খল করিয়া লিখিয়াছেন এবং প্রত্যেক বিষয় এত পরিস্কার করিয়া বুঝাইয়াছেন যে তাঁহার গ্রন্থ পাঠ না করিলে কাহারই উক্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন সম্পূর্ণ হইবেক না।' এই প্রবন্ধেরই এক জায়গায় মিল (যিনি ব্যক্তিপ্রাধান্য-বাদী) ও কোম্তের (যিনি সমষ্টির স্বার্থবাদী) মধ্যে প্রতিতুলনা করে তিনি বলেছেন, 'মতদ্বয় মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ এবং কোনটি নিকৃষ্ট তদ্বিষয়ে আমরা কোন কথা বলতে পারি না।' অনত্র তিনি বলেছেন, 'অর্ধেক বেন্থাম অর্ধেক কোম্তের' মধ্যে 'সমুচিত সামঞ্জস্য বিধানের কথা।' কেননা, 'চিত্তমধ্যে এই দুই মতের সমুচিত সামঞ্জস্যই আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা।' যা হোক, সমষ্টির স্বার্থ (কোম্ত) ও ব্যক্তিস্বার্থানুরাগ (বেন্থাম বা মিল) এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য করা যে ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না সে ক্ষেত্রে কী করা তা নিয়ে বঙ্কিমের দ্বিধা ছিল সে সময়ে। এই লেখার এক দশকের মধ্যেই লেখা হবে আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী ও সীতারাম উপন্যাস ত্রয়ী। তখন এসব দ্বিধা কেটে যাবে। সমষ্টির কল্যাণের জন্য ব্যক্তিস্বার্থকে প্রয়োজনে তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে- এই দাঁড়াবে তার অভিমত। ভক্তি ও বাহুবল সেখানে লিবারেল ইনডিভিজুয়ালিটির বদলে জায়গা করে নেবে। ব্যক্তির ইউটিলিটির বদলে সামষ্টিক ইউটিলিটির ওপরে জোর দেবেন তিনি, যার অন্য নাম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ।
শুধু আনন্দমঠ নয়। ইউটিলিটির সামষ্টিক ব্যাখ্যা কমলাকান্তর দপ্তরেও আছে। যেমন কমলাকান্তের দপ্তরে তৃতীয় সংখ্যার শিরোনাম ছিল 'ইউটিলিটি বা উদর-দর্শন'। বঙ্কিম যেখানে ইউটিলিটারিয়ান দর্শনের সার-সংক্ষেপ টানছেন এভাবে : 'এই মতের সার কথা এই যে যাহা হিতকর, তাহাই অনুষ্ঠেয় ও কর্তব্য। যাহা অহিতকর, তাহা বর্জনীয় এবং অকর্তব্য। হিতাহিত ফলোৎপাদকতা ভিন্ন কর্তব্যাকর্তব্যের অর্থাৎ পুণ্য পাপের- অন্য লক্ষণ নাই।' এই দর্শনকে অস্ত্র করেই তিনি 'কৃষ্ণ-চরিত্রে' বললেন, 'যাহা লোকহিতকর তাহাই ধর্ম', অর্থাৎ ধর্মের বিচার কেবল শাস্ত্র-অনুযায়ী করা উচিত নয়। এভাবে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র স্থাপিত হলো।
১২৭৯ ভাদ্র সংখ্যায় ছাপা হয় 'স্বস্বভাবানুবর্তিতা' মানে ইনডিভিজুয়ালিটি নিয়ে বঙ্কিমের প্রবন্ধ। সেখানে মিলের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে বঙ্কিম লিখলেন, 'মিল বলেন যে, যাহাতে অন্য কাহার সুখের ব্যাঘাত হয়, অথবা সমাজস্থ অধিকাংশ লোকের অসুখ জন্মে, অথবা যেখানে প্রত্যেকের কিছু কিছু কষ্ট বা ক্ষতি সহ্য না করিলে সমাজ রক্ষা হয় না, এরূপ স্থলে স্বেচ্ছাচার এবং স্বস্বভাবানুবর্তিতা নিবারণের জন্য বলপ্রয়োগ করা অন্যায় নহে।' প্রশ্ন উঠে, বলপ্রয়োগের এ নিয়মটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কি-না, নাকি সে ক্ষেত্রে মিলের অন্য নিয়মটিই কেবল খাটবে যেখানে তিনি বলছেন, 'সকল স্ব স্ব জ্ঞান ও বিবেচনানুসারে যে মত ইচ্ছা তাহাই অবলম্বন করিবে, তাহাতে প্রচলিত মতের বিরোধীদিগের প্রতি কোন প্রকার অত্যাচার করা অন্যায়'? কোন নিয়মটা প্রয়োগ করা হবে নীতিশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে যথার্থ?
[ক্রমশ]
মন্তব্য করুন