ফাতেমাতুজ জোহরা তার মা-বাবাকে মনে করতে পারে না। আড়াই বছর বয়সে ঢাকার রাস্তায় ফুটফুটে মেয়েটিকে রেখে চলে যায় বাবা-মা। অচেনা শহরে ছোট্ট শিশুটি পথে পথে ঘোরে। কথাও বলতে পারত না। এসব দূর অতীতের নয়, পাঁচ বছর আগের কথা। পরে ফাতেমা পেল নিরাপদ আশ্রয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখাও শুরু হলো। এখন সে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে।

মা-বাবাহীন জান্নাতুল, সুমাইয়া, মারিয়া, তুলির গল্পও প্রায় একই রকম। তাদের ফুটপাত থেকে উদ্ধার করে আশ্রয় দিয়ে, লালন ও পরিচর্যার মাধ্যমে নতুনভাবে আবার জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি)।

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলা শহরের পথে ঘুরে বেড়ানো এমন শিশুর নিরাপদ আশ্রয় এখন এএসডি পরিচালিত 'আনন্দ নিবাস'। পথশিশুদের ওপর জরিপ, বেশি ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের চিহ্নিত করা, মা-বাবার খোঁজ করা, না পেলে থাকা-খাওয়া, স্কুলে যাওয়াসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে শিশুদের। সেই টুকরো টুকরো গল্প শোনালেন রাজধানীর আদাবরের আনন্দ নিবাসের ইনচার্জ ফিরোজা আক্তার রূপা। তিনি বলেন, মা-বাবাহীন পথশিশুদের আলোর পথে আনার কাজটি সহজ ছিল না। এদের অনেকেই মাদকাসক্ত ছিল। আনতে গেলে অনেকেই ছেলেধরা মনে করেছেন। আনন্দ নিবাসে আনার পর মাদকাসক্ত শিশুরা ভয়াবহ আচরণ করেছে। গালি দিত, মারধর করত। কিন্তু আস্তে আস্তে সেবাযত্ন দিয়ে তাদের স্বাভাবিক করেছি। আমরা শিশুদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করি। এখানে বসবাসরত শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানোর পাশাপাশি নাচ-গানের শিক্ষক, বিনোদনা, থাকা-খাওয়া, পড়ালেখার সরঞ্জাম, পোশাক, জুতা বা স্যান্ডেলসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিস সরবরাহ করা হয়। স্থানীয় কমিউনিটিকেও আমরা এই কাজে যুক্ত করেছি।

তিনি বলেন, এখানে স্নেহ-ভালোবাসার সঙ্গে আছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণ। আছে নিয়মানুবর্তিতা। শিশুরা নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজেদের কাজ নিজেরাই করে। সবকিছু দেখাশোনার জন্য আলাদা লোক থাকলেও শিক্ষার্থীরা পর্যায়ক্রমে তাদের সহযোগিতা করে।

আদাবরের আনন্দ নিবাসে গিয়ে দেখা দেখা গেল বর্ণিল এক চিত্র। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মেয়েদের কেউ পড়ালেখা করছে, কেউ টিভি দেখছে, কেউ আবার একমনে ছবি আঁকছে। নিজের জীবনের লক্ষ্যের কথা জানাতে গিয়ে অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া জান্নাতুল ফেরদৌস বলল, 'এএসডি আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছে। আমি নার্স হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। আমার মতো অনেক শিশুকে বাঁচাতে চাই। ' বৈচিত্র্যময় স্বপ্নের কথা বলতে এগিয়ে আসে ৩০টি মুখ। একেকটি মুখ যেন একেকটি স্বপ্নের আবাসভূমি। ওরা এখন স্কুলে যায়। কষ্ট ভুলে তারা এখন স্বপ্ন বুনছে। আনন্দ নিবাসে পরিচর্যা পেয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন এঁকে চলেছে অসংখ্য ছেলেও। তারা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় হেঁটে চলেছে নতুন জীবনের দিকে।

এএসডির ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যাট হাই রিস্ক প্রকল্পের আওতায় ২০১২ সাল থেকে রাজধানীর তিনটি এলাকায় তিনটি 'আনন্দ নিবাস' পরিচালিত হয়। এর মধ্যে দুটি মেয়েদের ও একটি ছেলেদের। এখানে রয়েছে ৯০ জন শিশু, যাদের বয়স সর্বনিম্ন চার বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৮ বছর পর্যন্ত।

মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করাই এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য বলে জানালেন এএসডির নির্বাহী পরিচালক জামিল এইচ চৌধুরী। তিনি বলেন, ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আনন্দ নিবাসে ভর্তি করানো হয়েছে প্রায় ৪০০ শিশু। শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি, পছন্দ ও দক্ষতা অনুযায়ী কোনো একটি কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষ করা হয়, যাতে পরবর্তী সময়ে তারা স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।

মন্তব্য করুন