পৌরসভার বিরোধ মীমাংসা বোর্ড আইন সংস্কার জরুরি

মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন, ম্যাব, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও সমকালের আয়োজনে মঙ্গলবার গোলটেবিল বৈঠকে অতিথিরা সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ০০:৪৭
দেশের পৌর এলাকায় বিরোধ মীমাংসা-সংশ্লিষ্ট ২০০৪ সালের আইনটি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার আইন বিশেষজ্ঞ এবং সুবিধাভোগীরা। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল সভাকক্ষে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে এ দাবি জানানো হয়। মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পৌরসভা সমিতি (ম্যাব), নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও সমকাল যৌথভাবে এর আয়োজন করে। এর সমর্থনে ছিল দি এশিয়া ফাউন্ডেশন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশনের (এমএলএএ) প্রকল্প সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মো. ইব্রাহিম মিয়া।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, গ্রাম আদালতের এখতিয়ার তিন লাখ টাকায় উত্তীর্ণের পথে থাকলেও পৌর বোর্ড আইনের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি এখনও ২৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এটি ১০ লাখ টাকায় উন্নীত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া রায় বাস্তবায়ন পদ্ধতি সহজতর করা, আইনটির শিরোনাম পরিবর্তন করে ‘পৌর আদালত’ নাম দেওয়া, মেয়রের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আপত্তি উপস্থাপন বা মেয়রের অনুপস্থিতিতে কে বোর্ডের দায়িত্ব পালন করবেন– তা স্পষ্ট করা জরুরি।
বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, আমরা এখনও পৌরসভাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারিনি। পৌরসভাকে অর্থনৈতিক ও কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী করা দরকার। পৌরসভার সব চেয়ারম্যানকে মেয়র বানানোর মাধ্যমে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে, এই সম্মানের সঙ্গে সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিরোধ মীমাংসা (পৌর) বোর্ড আইন এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যাতে অন্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়; বরং যেন অন্য আইনের পরিপূরক হয়। স্থানীয় সরকারের যে আইনটি রয়েছে, সেটির আওতায় কীভাবে এটিকে কার্যকর করা যায় বা শক্তিশালী করা যায়, তা দেখতে হবে।
সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, আদালতে বিচারের পাহাড় জমে গেছে। এগুলো সময়মতো মীমাংসিত হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বিরোধ মীমাংসায় পৌর মেয়ররা কীভাবে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন, তা দেখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অনারারি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, দেখা যায়, বিচ্ছেদের পর নারীরা অল্প কিছু ভরণপোষণের মীমাংসার জন্য কোর্টের বারান্দায় ঘুরতেই থাকেন। এ ধরনের সমস্যায় আপস-মীমাংসা সম্ভব। বিরোধ মীমাংসায় নারী কাউন্সিলরদের অংশগ্রহণ জরুরি।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, পৌরসভার মেয়র একজন রাজনীতি থেকে আসা মানুষ। তাঁকে লোকজন ভোট দেন; কাউন্সিলরও তার ব্যতিক্রম নন। ফলে আনুষ্ঠানিক যে বিচার ব্যবস্থা, সেটি কখনও সালিশের বিকল্প হতে পারে না। সালিশও বিচার ব্যবস্থার বিকল্প নয়। সালিশে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি থাকে, সমঝোতার ক্ষেত্রে সব সময় ন্যায়বিচার হয় না; ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। বিচার ব্যবস্থা তা নয়।
এমএলএএর প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট খান মোহাম্মদ শহীদ বলেন, ৪২ লাখের বেশি মামলা আদালতে বিচারাধীন। যারা আদালতে যাচ্ছেন, তাদেরও বড় একটা অংশ ছোটখাটো বিষয় মীমাংসা করে ফেলতে পারে।
নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন বলেন, ২০০৪ সালের পৌর এলাকার বিরোধ মীমাংসা বোর্ড আইনের দুটি দুর্বলতা রয়েছে। কাউন্সিলরদের জন্য স্থায়ী কোনো কার্যালয় নেই। প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য তাদের নির্দিষ্ট কার্যালয় বা ঘর জরুরি। নারী কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ততা সুনিশ্চিত করা জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আমরা আজ পৌর এলাকায় বিরোধ মীমাংসা আইনের সংস্কার নিয়ে আলোচনা করছি; কিন্তু আমিসহ বহু সাংবাদিক ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের আলোচনায় ছিলাম। সবাই অনেক প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু কোনোটিই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
বাংলাদেশ পৌরসভা সমিতির সভাপতি ও নীলফামারী পৌরসভার মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ বলেন, বিরোধ মীমাংসা আইনে যে ২৫ হাজার টাকার ক্ষমতা দেওয়া আছে, দেখা যায়, পৌর এলাকায় এক শতক জমির দাম ২০ লাখ টাকার বেশি। এখানে আমাদের আইন প্রয়োগের এখতিয়ার থাকে না। আইনটি সংস্কার হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, তাতেও আমাদের নজর দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ পৌরসভা সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র খালিদ হোসেন ইয়াদ বলেন, উদ্বেগের বিষয় হলো যখন একজন বিচারপতির কাছে ১ হাজার ৯০০ মামলা থাকে। এটি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। প্রধান বিচারপতি যথেষ্ট উদ্যোগও নেন। কিন্তু চেষ্টার পরও কাজ হয় না। সামঞ্জস্য আনার জন্য বিদ্যমান আইনটির সংস্কার আনা যেতে পারে।
দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ বলেন, কয়েকটি উপাত্ত থেকে জানতে পারি, ১৩ শতাংশ মানুষ আদালতের মাধ্যমে তাদের বিরোধ নিরসন চায়। একই উপাত্ত বলছে, ৫৮ শতাংশ মানুষ মনে করে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই তাদের বিরোধ মেটাতে বেশি সক্ষম। লোকজন জনপ্রতিনিধিদের কাছে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র জাকিয়া খাতুন বলেন, যে আইন সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা যেন জনগণের ভোগান্তির কারণ না হয়, সেটিই আমার একমাত্র প্রত্যাশা।
সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব পরিমল কুমার দেব বলেন, পৌর এলাকায় বিরোধ মীমাংসা বোর্ড আইনটির বিচারিক আর্থিক ক্ষমতা ২৫ হাজার টাকায় সীমাবদ্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে। পৌরসভায় তো এক কাঠা জমির দাম কয়েক লাখ টাকা। সেখানে ২৫ হাজার টাকা তো কিছুই না। এ জন্য পৌর মেয়রের কাছে মানুষ যায় না।
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম বলেন, পৌরসভা আইন ২০০৯ সালে হয়েছে, যেটি ২০১০ ও ২০২২ সালে সর্বশেষ সংশোধন হয়েছে। অতএব, এখন সংস্কার করতে গেলে দুটি আইনকে মাথায় নিয়ে সংস্কার করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট সাদিয়া তাসনিম বলেন, এখানে দুটি ইস্যু– এক হচ্ছে মামলার জট কমছে না, আরেকটি হচ্ছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি। কোনো পৌর এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প চালু হলে সেখানকার সম্পত্তির দাম দ্রুত বেড়ে যায়। ফলে আইনের সংস্কার করে মীমাংসার বিষয়ের টাকা তিন লাখ করা হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সেটি এক ধাপ অগ্রগতিই হবে।
ঢাকার সাভার পৌরসভার কাউন্সিলর (৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড) অ্যাডভোকেট সুলতানা রাজিয়া বলেন, নারীরা সব কথা আদালতে গিয়ে বলতে পারেন না। লজ্জা বা ভয় কাজ করে; অনেকে পর্দা করেন। নির্যাতনের শিকার হলে শরীরের ওই অংশ দেখাতেও পারেন নারী কাউন্সিলর বা জনপ্রতিনিধি উপস্থিত থাকলে।
দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জাকারিয়া বলেন, পৌর এলাকায় বিরোধ মীমাংসা আইনের যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেটি সম্পন্ন হলে আইনটি বাস্তবায়নে পৌরসভায় পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও অন্যান্য কাঠামো নিশ্চিত করা জরুরি।
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ওয়াহিদা বেগম বলেন, আমরা এখানে আইন নিয়ে অনেক কথা বলছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিধি নিয়েও এখনই কাজ করা বা কথা বলা জরুরি বলে মনে করি।
- বিষয় :
- আইন সংশোধন