ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

লোকসানে বন্ধ তাঁত, পেশা ছাড়ছেন মালিক-শ্রমিক

লোকসানে বন্ধ তাঁত, পেশা ছাড়ছেন মালিক-শ্রমিক

সাঁথিয়া পৌর এলাকার পিপুলিয়া মহল্লায় তাঁত কারখানায় কাজ করছেন এক নারী সমকাল

 জালাল উদ্দিন, সাঁথিয়া (পাবনা)

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০৯

সাঁথিয়া পৌরসভার পিপুলিয়া এলাকার মোতালেব হোসেনের একসময় ১৮টি তাঁতযন্ত্র ছিল। লোকসানে ১২টি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংক, মহাজন ও তাঁত বোর্ড থেকে ঋণ নিয়েছেন ৮ লাখ টাকা। মাসে ২২ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। তবে লোকসানের কারণে তা ঠিকমতো দিতে পারছেন না। একই এলাকার ব্যবসায়ী মিরাজুল ইসলাম মল্লিক। তাঁর ভাষ্য, পাইকারি ক্রেতাদের কাছে ১৬ লাখ টাকা অনাদায়ী রয়েছে। লোকসানের কারণে তিনি পেশা বদলে মুরগি, মাছ ও গরুর খাবারের ব্যবসা করছেন। তার ১০টি তাঁতই বন্ধ হয়ে গেছে।
পাবনার সাঁথিয়া এলাকার তাঁতপণ্যের চাহিদা দেশজুড়ে। তবে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে টিকতে না পেরে জৌলুস হারাতে বসেছে এ শিল্প। সুতা, রং, রাসায়নিক দ্রব্যসহ তাঁতপণ্য উৎপাদন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বেশির ভাগ তাঁতযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ একসময় কাকডাকা ভোরে মাকুর খটখট শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙত। এখন অধিকাংশ গ্রামেই তাঁতপল্লিতে সে কর্মব্যস্ততা নেই।
অধিকাংশ তাঁতযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর সঙ্গে যুক্ত অনেকে বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। লোকসান সামলাতে সহায়-সম্বল বিক্রি করছেন। অনেকে ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন। কম মজুরির কারণেও অনেকে পেশা পরিবর্তন করছেন। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে গ্রাম ছেড়েছেন অনেকে। এলাকার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প রক্ষায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি উপকরণের দাম কমানো ও পণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি সংশ্লিষ্টদের।
সাঁথিয়া তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টার থেকে জানা গেছে, ২০২০ ও ২০২১ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী উপজেলায় তাঁত ছিল ৪ হাজার ৯৭৭টি। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে ২ হাজার ৯৮৬-তে দাঁড়িয়েছে। তাঁত মালিক ছিলেন ১ হাজার ৪৬৫ জন। বর্তমানে আছেন ৮৭৯ জন। শ্রমিক ১৪ হাজার ৯৩১ থেকে কমে ৮ হাজার ৯৫৮ জনে দাঁড়িয়েছে।
চক কোনাবাড়িয়া গ্রামের তাঁত শ্রমিক অঞ্জনা খাতুন। সারাদিন কাজ করে চার-পাঁচটি লুঙ্গি বুনতে পারেন তিনি। প্রতিটি ৩০ টাকা হিসেবে মজুরি পান ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। এ টাকা দিয়ে ঠিকমতো সংসারই চলে না তাঁর। শ্রমিক আমিরুল ইসলাম ও মনিরুল ইসলামের ভাষ্য, তাঁরা প্রতিদিন মজুরি পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অন্য কাজ না পারায় বাধ্য হয়ে কম মজুরিতে তাঁতে কাজ করছেন তিনি।
কয়েকজন তাঁতির বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, দু’একটি যন্ত্র চালু থাকলেও বেশির ভাগ তাঁত বন্ধ। জমেছে ধুলার আস্তর। শ্রমিকরা আগে দুই শিফটে কাজ করতেন। এখন নিয়মিত কাজই থাকে না। তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যের দাম বেড়েছে দুই-তিন গুণ। আগে এক ডোপ সুতার দাম ছিল ১৩ হাজার টাকা, এখন ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। ৬২ কাউন্টের সুতা ১৫ হাজার থেকে বেড়ে ২৩ হাজার টাকা হয়েছে।
৮২ কাউন্টের সুতা ১৮ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২ হাজার টাকা। এক বস্তা (৫০ কেজি) কস্টিক সোডার দাম ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৪০০, এক ড্রাম (৫০ কেজি) হাইড্রোস ৪ হাজার ৫০০ থেকে ১৮ হাজার, এক কেজি গ্রিন কালার ২ হাজার ৮০০ থেকে বেড়ে ৫ হাজার ৫০০, ব্লু ২ হাজার ৭০০ থেকে ৫ হাজার ৬০০, ভায়োলেট ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার ১০০, ব্রাউন ৩ হাজার ১০০ থেকে ৭ হাজার, সালফার ব্ল্যাক প্রতি কেজি ১০০ থেকে ২৫০ এবং ব্লিচিং ৮০ থেকে বেড়ে ৫০০ টাকা কেজি হয়েছে। 
উপজেলার কারিগরপাড়ার বিশ্বাস সুতা হাউস অ্যান্ড লুঙ্গি প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক সেলিম বিশ্বাস বলছিলেন, প্রতি থান (চারটি) লুঙ্গির উৎপাদন খরচ হয় ১ হাজার টাকা। অথচ লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে ৯৫০ টাকায়। ক্রেতাদের কাছে ৩০ লাখ টাকা বাকি পড়ে আছে। অনেকেই টাকা পরিশোধ না করে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর ৩২টি তাঁতের মধ্যে অল্প কয়েকটি চালু আছে। ব্যাংকে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে। এগুলো পরিশোধ হলে তিনি আর তাঁত চালাবেন না।
তাঁতিরা জানান, আগে তিন ধরনের তাঁত– খটখটি, পিটলুম ও চিত্তরঞ্জনের প্রচলন ছিল। তৈরি করতে খরচ হতো ৬ হাজার টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। অটো পাওয়ারলুম (বিদ্যুৎচালিত) তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বাংলা পাওয়ারলুমে ৬০-৬৫ হাজার টাকা খরচ হয়। অনেকে লোকসান দিয়ে ২০-২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তাঁতি জানান, দুটি তাঁত চালাতে গিয়ে প্রায় ২ লাখ টাকা ঋণ হয়েছিল তাঁর। মহাজনদের চাপে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় রিকশা চালান তিনি। তাঁর মতো ব্যবসায়ী সজল মোল্লা, হাসান শেখ, রবিউল আলম, সেলিম হোসেন, হালিম প্রামাণিকসহ অনেকে লোকসানে ঋণের ফাঁদে পড়ে পেশা বদলে এলাকা ছেড়েছেন।
পৌর সদরের তাঁত মালিক হাফিজুর রহমান লাল বলেন, বাপ-দাদার আমলের সে ব্যবসা আর নেই। লোকসানের কারণে তিনি অন্য ব্যবসার সন্ধানে আছেন। পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ‘ইউনিয়ন প্রাথমিক তাঁতি সমিতির’ ২৯২ জন সদস্যের ৮০০ তাঁত ছিল। সভাপতি রহম আলী বলেন, এখন ১৬২ জন তাঁতির ৪৯৬টি তাঁত আছে।  তাঁতিদের ভর্তুকি এবং স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার দাবি তাঁর।
এ বিষয়ে সাঁথিয়া তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টারের সমন্বয়কারী কর্মকর্তা বসুদেব চন্দ্র দাস বলেন, উপকরণের দাম বাড়লেও তাঁতে উৎপাদিত পণ্যের দাম সে তুলনায় বাড়েনি। লোকসান দিতে দিতে অনেকে তাঁত বন্ধ করে দিচ্ছেন, পেশা বদলাচ্ছেন। শ্রমিকেরাও অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×