ঢাকা সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

বর্ষায় অপরূপ ধামরাই

বর্ষায় অপরূপ ধামরাই

এসময় ধামরাইয়ে বেড়াতে গেলে হাওরের অনুভূতি পাবেন।

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪ | ১৭:২৫ | আপডেট: ১২ আগস্ট ২০২৪ | ১৭:৫৩

ঢাকার উপকণ্ঠে ধামরাই। শহরঘেঁষা হলেও এ উপজেলাটির নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। বিশেষ করে বর্ষায় ধামরাইয়ের কাজিয়ালকুণ্ড, আড়ালিয়া, মাখুলিয়া, কানারচর, মাধবপট্টিসহ সিঁতী গ্রামটা নতুন পানির আগমনে অসাধারণ হয়ে ওঠে। এসব গ্রামের মধ্যে কয়েকটিতে রয়েছে প্রচুর হিজল ও কড়চ গাছ; যা ভ্রমণপিপাসুর মনে হাওরের অনুভূতি এনে দেয়। বংশী ও ধলেশ্বরী নদীঘেরা গ্রামের নীচু ফসলি মাঠগুলো বর্ষা আর বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। হিজল-কড়চ গাছগুলোর অবস্থা হয় ডুবুডুবু। একেকটি গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেখতে অনেকটা দ্বীপের মতো লাগে। অধিবাসীদের চলাচলের মাধ্যম হয়ে উঠে একমাত্র নৌকা। স্থানীয়রা তাদের কৃষি পেশা পাল্টিয়ে মাছ শিকারিতে পরিণত হন। থইথই পানিতে পাতিহাঁসের পেক পেক আওয়াজ, আর দলবদ্ধভাবে ভেসে বেড়ানোর অপরূপ দৃশ্য যে কারোরই নজর কাড়ে। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় সামান্য ভাড়ায় কয়েক ঘণ্টা ঘুরে বেড়ানো যায়। টলটলে স্বচ্ছ পানির তলদেশের গভীরতা মুগ্ধ করে। ইচ্ছে হলেই ডুবসাঁতারে মেতে ওঠা যায়। সঙ্গে নেওয়া হ্যামোকে দোল খেতে খেতে, ঝুমবৃষ্টি উপভোগ করতে পারলে দিনটি স্মরণীয় হয়ে রবে। খোলা আকাশ থেকে সরাসরি পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার যে মন্ত্রমুগ্ধ আওয়াজ, তা হয়তো আজও অনেক মানুষ শুনতেই পায়নি।

‘রোদ হচ্ছে, মেঘ হচ্ছে, খেঁকশেয়ালের বিয়ে হচ্ছে...।’ ঘুরতে গিয়ে ভাসমান নৌকায় ঝুপ করে যখন বৃষ্টি আসে তখন এরকম বিয়ের মজাটা পাওয়া যায়। আবহাওয়া পরিবেশ পরিস্থিতি ভেদে যেকোনো ভ্রমণের আনন্দ সীমাহীন হয়ে উঠতে পারে। ঝুপ করে আসা বৃষ্টি যদি ঝম ঝম ঝরতে থাকে, তাহলে এর ভালোলাগার মাত্রা পরিমাপের আর সুযোগই থাকে না। দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা সব সময় এরকম আকস্মিক ব্যাপারগুলোই পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রাখে। চলতি মৌসুমে যারা সময় সুযোগের অভাবে হাওরে যেতে পারছেন না, তাদের সেই আনন্দ অনেকটাই এখানকার বর্ষার পানি ও প্রকৃতির রূপে পাওয়া যেত পারে।

ঘণ্টাখানেক নৌকায় ঘুরে ছবির মতো সুন্দর সিঁতী গ্রামের মেঠো পথে, সারি সারি তালগাছের ছায়ায় হেঁটে/অটো’য় চড়ে আড়ালিয়া বাজার। সেখানকার টঙ দোকানের গরম গরম আলুপুরি, শিঙাড়া ও গাভির দুধের মালাই চা’র স্বাদ অসাধারণ।

খেয়েদেয়ে চাঙ্গা হয়ে বাজারের পাশেই চৌটাইল গ্রামের পিঠঘেঁষে বয়ে যাওয়া ধলেশ্বরীর বুকে, ডুবসাঁতারে মাতামাতি করে শৈশবের স্মৃতি হাতড়ানোর মোক্ষম সুযোগ রয়েছে। বিনা টিকিটে ইচ্ছেমতো গোসল করে চলে যেতে পারেন কাজিয়ালকুণ্ড। সড়কের দু’পাশে সৃজন করা গাছের ছায়ায় পেতে রাখা বেঞ্চে, একবেলা পার করে দেওয়া যায় অনায়াসে। গাছের ফাঁক গলিয়ে হুহু করে আসা ফুরফুরে বাতাস চরম গরমেও স্বস্তি এনে দেবে। ধানের নাড়ার স্তূপ ও পাখির ডাক অপার্থিব সময় পার করাবে। ঘুরতে ঘুরতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। পেটে নিশ্চয় লেগেছে টান। কাজিয়ালকুণ্ডের ঢুলীভিটা সড়কে রয়েছে নানান ক্যাটেগরির রেস্টুরেন্ট। খাবারের মানের চাইতে টাকাটা একটু বেশিই মনে হবে। এরচেয়ে ভালো নিজেরা সদাইপাতি করে, গ্রামের ভেতর কোনো টঙ দোকানিকে ম্যানেজ করে রান্না করিয়ে নিতে পারেন। এই রান্নার তরকারি আরও বেশি মজাদার। যেটিকে বলা হয় অল্প তেলে মচমচা। পেট ঠান্ডাত সব ঠান্ডা।

এবার হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতে পারেন মাখুলিয়া। ধান শুকানোর মনোরম মুহূর্ত, গ্রামের বউ-ঝিদের ধান গোলায় তোলার ব্যস্ততা–যান্ত্রিক রাজধানীর পাশে মাখুলিয়া গ্রামটা অনন্য। মানুষগুলোও বেশ সহজেই আগন্তুকের সঙ্গে মিশে যায়। মানুষ ও গ্রামীণ পরিবেশে মিলেমিশে একাকার হতে হতেই হয়তো, ততক্ষণে কাঁঠাল পাকা গরমে শরীরটা ঘেমে যাবে। ঘেমেই যখন গিয়েছে তাহলে কানারচরেরর দিকে এগোনো যেতে পারে। সেখানটায় রয়েছে বিস্তৃত ফসলি জমি। মাটির গভীর থেকে ফসলের জন্য তোলা, স্যালো মেশিনের নলের সামনে বসে আরও একবার গোসল করে নিন। আহ কী পানিরে! চোখ যত দূর যায়, শুধু কাঁচাপাকা ধান আর ধান। মাথার ওপর আমগাছের ছায়া। এমন মনোরম পরিবেশে হিমহিম শীতল পানিতে মন ভরে গোসল করা যেতেই পারে।

সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়বে ঠিক তখনই মধ্য ফোর্ডনগরের দিকে ছুটে, বটতলা ছাড়িয়ে বাঁশের সেতু মাড়িয়ে ইঞ্জিন বোটে চড়ে বংশী নদীতে ভেসে যাবেন। মাঝির সঙ্গে কথা হবে, ট্রলার যাবে দক্ষিণ দিকে। সঙ্গে নেবেন ছোলাবুট ভুনা, পিঁয়াজু ও হাতে ভাজা মুড়ি। নারী ও শিশুর রুচির জন্য ফুটপাতে বসা দোকানি থেকে পাঁচমিশালী আচারও নেওয়া যেতে পারে। বর্ষার পানিতে বংশীর ফিরে আসা যৌবনের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ, আর উম্মাদ হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মাখানো মুড়ি খাওয়ার স্বাদ হবে অতুলনীয়। মাখা মুড়ি শেষ হবার আগেই হয়তো আবিষ্কার করবেন, জীবনটা এখানেই অনেক সুন্দর। ভাসতে ভাসতে ভর সন্ধ্যায় নেমে পড়ুন সাভারের নামাবাজার গুদারা ঘাটে।

কীভাবে যাবেন: ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে নিজস্ব/ভাড়া করা গাড়ি, মোটরসাইকেল/ বাইসাইকেল কিংবা গণপরিবহনে সাভারের থানা রোড হয়ে নামাবাজার ব্রিজের ওপর দিয়ে গিয়ে দিনে দিনে ঘুরে আসা যাবে। উপজেলা ধামরাই। কিন্তু সাভারের থানা রোড/বাজার রোড দিয়ে এর যাতায়াত সহজ।

আরও যা দেখা যাবে: খুব ভোরে পৌঁছতে পারলে আড়ালিয়ার পাশে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার নয়নাভিরাম খড়ারচর, কাংশা ও ফড়িঙ্গা গ্রামগুলোও ঘুরে আসা যাবে। গ্রামগুলো রাজধানীর পাশে হলেও এখনও আবহমান বাংলার আদি সৌন্দর্যের দেখা মিলে। শোনা যায় চেনা-অচেনা পাখির গান।

বিশেষত্ব: পূর্ণিমায় ক্যাম্পিং করার জন্য ধলেশ্বরীর তীর হতে পারে অসাধারণ একটি জায়গা।

টিপস: মনের মতো ঘোরাঘুরি ও ছবি তোলার জন্য সঙ্গে রাখুন কয়েক সেট জামাকাপড়। ভোজনরসিক হলে সকালের নাশতায় নামাবাজারের থাপড়ানো রুটি ও দই-মিষ্টি তালিকায় রাখতে পারেন।

ছবি: লেখক

আরও পড়ুন

×