গৃহনির্মাণে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার জরুরি
সমকাল-ইসলামিক রিলিফ গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
‘দুর্যোগ সহনশীল গৃহনির্মাণে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার: প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। শনিবার সমকাল কার্যালয়ে - সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৬
নগরায়ণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। নগরায়ণে যেসব উপকরণ ব্যবহার হয়, সেগুলো পরিবেশবান্ধব নয়। অথচ প্রাকৃতিকভাবে সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে স্বল্প খরচে গৃহনির্মাণ করে এ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। তাই দেশি প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব আবাসন নির্মাণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দৈনিক সমকালের সভাকক্ষে এক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন। ‘দুর্যোগ সহনশীল গৃহনির্মাণে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার: প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এ বৈঠকের আয়োজন করে সমকাল ও ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ।
এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোশতাক আহমেদ, হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) প্রিন্সিপাল রিসার্চ অফিসার মো. নাফিজুর রহমান, রিভারাইন পিপলের ট্রাস্টি এফ এম আনোয়ার হোসেন, কারিতাস বাংলাদেশ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সেক্টরের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার (শেল্টার অ্যান্ড সেটেলমেন্টস) ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রিসেন্ট অ্যান্ড রেড ক্রসের (আইএফআরসি) শেল্টার ক্লাস্টার বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর এ কে এম জহিরুল আলম এবং ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের কোঅর্ডিনেটর (টেকনিক্যাল) জাকির হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন।
বৈঠকে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ইসলামিক রিলিফের হিউম্যানিটারিয়ান অ্যান্ড রেজিলিয়ান্স প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. শামসুজ্জামান এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ইসলামিক রিলিফের কান্ট্রি ডিরেক্টর তালহা জামাল।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বলা আছে, ২০২৫ সালের পর সরকারি কোনো কাজে আর মাটি পোড়ানো ইট ব্যবহার করা হবে না।’ বিষয়টি বাস্তবায়নে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এইচবিআরআইকে রোডম্যাপ তৈরির নির্দেশনা দেন তিনি। পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘এ জন্য তিন মাস সময় নেওয়া যেতে পারে। রোডম্যাপ অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিতে হবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতেই কাজ শুরু করতে হবে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসনের ব্যবস্থা করে জানিয়ে রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এখন আমরা চাচ্ছি, ইটের জায়গায় ব্লক ব্যবহার করতে। এ ছাড়া কোন ধরনের বাড়ি টেকসই হবে এবং নির্মাণ খরচ কম হবে– এ নিয়েও গবেষণা করতে হবে।’
মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘বাড়ি নির্মাণে প্রতিটি অঞ্চলে স্থানীয় জ্ঞানের চর্চা হয়। এই জ্ঞান ধরে রাখতে হবে। তাছাড়া, বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় উপকরণ হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে।’
ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বাঁশের বাড়িতে খরচ অনেক কম। কিন্তু এতে আমরা বিনিয়োগ করছি না।’ বাঁশ প্রক্রিয়া করে ১০০ বছর পর্যন্ত টেকানো সম্ভব বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মোশতাক আহমেদ বলেন, সিলেটে একসময় ‘আসাম’ টাইপের ভবন নির্মাণ করা হতো। এখন জায়গার অভাবে শহরে সেটা করা সম্ভব নয়, কিন্তু গ্রামে করা যেতে পারে। কারণ, এ ধরনের ভবন ভূমিকম্প সহনশীল।
তালহা জামাল বলেন, দেশি জ্ঞান ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব টেকসই আবাসন নির্মাণ জরুরি। কার্বন নিঃসরণ ও গৃহনির্মাণে খরচ কমাতে এটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। তবে একা এটি করা সম্ভব নয়, অংশীজনের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমেই এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে।
শামসুজ্জামান বলেন, ‘গৃহনির্মাণের অনেক উপকরণ সহজলভ্য নয়। একই সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতার বিষয় রয়েছে। পরিবেশবান্ধব আবাসনে ডিজাইনের বিষয়েও ভাবতে হবে।’ ইটের পরিবর্তে যা এসেছে, সেগুলোর স্থায়িত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা দেখার দাবি রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নাফিজুর রহমান বলেন, উপকূলীয় এলাকায় এনজিওর সহায়তায় ঘূর্ণিঝড় সহনশীল কিছু বাড়ি বানিয়েছি। এগুলো বেশ প্রশংসিত হয়েছে। বাড়িগুলো তৈরি স্থানীয় উদ্যোগে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো তহবিল। ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে কিছু করে না। এটি আমাদের দেখতে হবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ফিন্যান্স করার সুযোগ আছে।
সরকার সহায়তা করলে ব্লক কিংবা ইট থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয় উপকরণ দিয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা তৈরি সম্ভব উল্লেখ করে এফ এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গ্রামে এখন ৪-৫ তলা ভবন হচ্ছে। এর জন্যও একটা নীতিমালা করা দরকার। জমি বাঁচিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে কীভাবে বাড়ি নির্মাণ করা যায়, সেটা দেখতে হবে।’ এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার নিয়ম চালু করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সিমেন্ট পরিবেশবান্ধব নয়, প্রকৃতিতে এর বিকল্প কী আছে, সেটি আমাদের চিন্তা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে
বিকল্প হতে পারে চুন। মাটির সঙ্গে চুন মিশিয়ে ব্লক বানানো গেলে খুবই ফলপ্রসূ হবে। এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
দেশে কাঁচা বাড়িই বেশি উল্লেখ করে জহিরুল আলম বলেন, যদি ৫০ বছর পরের কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে এই ঝুপড়িগুলোই একসময় পাকা কিংবা সেমিপাকা হবে। তাই ভবিষ্যতে যারা এ ধরনের বাড়ি নির্মাণ করবেন, তারা যেন পরিবেশবান্ধব করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
জাকির হোসেন বলেন, পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করে গৃহনির্মাণ করতে গিয়ে আমরা কংক্রিট ব্লক ব্যবহার করি। তবে এলাকায় এমন উপকরণ সহজলভ্য নয়। অন্য জায়গা থেকে আনতে হয়, এতে খরচ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, মানুষ ইটের বাড়ি বেশি টেকসই মনে করে। তাই উপকরণ সহজলভ্য করতে হবে। মানুষকে পরিবেশবান্ধব বিকল্প সম্পর্কে জানাতে হবে।
শেখ রোকন বলেন, বন্যা ও নদীভাঙন প্রবণ এলাকায় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, আশ্রয়কেন্দ্র– সবই কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয়। কিন্তু নদী
ভাঙনপ্রবণ এলাকার স্থাপনা কাঠ ও বাঁশ দিয়ে করা উচিত। এতে শুধু নাটবোল্ট লোহার হবে, যাতে নদীভাঙন হলে সেই স্থাপনা খুলে অন্য জায়গায় নেওয়া যায়।
- বিষয় :
- পরিবেশবান্ধব ইট
- গৃহনির্মাণ