ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

অর্থহীন সম্মেলনে তিরস্কারের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো

অর্থহীন সম্মেলনে তিরস্কারের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো

আজারবাইজানের বাকুতে কপ২৯ সম্মেলনের পরিবেশকর্মীদের প্রতিবাদ। ছবি: সমকাল

জাহিদুর রহমান, আজারবাইজান থেকে ফিরে

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:২৪ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২১:৩৫

সম্মেলন শুরুর আগেই চাউর বিতর্ক, সন্দেহ ও আশঙ্কা সত্যি হলো। এবারও ব্যর্থ হতে চলেছে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯। সম্মেলনে টানা ১২ দিনই হতাশার ছড়াছড়ি।

গতকাল শুক্রবার সময়সীমা শেষ হলেও দেখা যায়নি ঐক্য কিংবা সমঝোতা। এরই মধ্যে জলবায়ু তহবিল নিয়ে বৈশ্বিক চুক্তির একটি প্রস্তাব নিয়ে শেষ মুহূর্তে মাথাচাড়া দেয় বিভাজন। নতুন প্রস্তাবে যে বিকল্প পথ দেখানো হয়েছে, তাতে কেউ হাঁটতে রাজি নন। এর পরও ঐকমত্যে পৌঁছানোর আশায় সম্মেলন শনিবার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

গতকাল সম্মেলনের প্রেসিডেন্সি ২০৩৫ সালের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ২৫০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের একটি খসড়া আর্থিক চুক্তি প্রকাশ করে, যা উন্নত দেশগুলোকে দিতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৈশ্বিক জোট জি৭৭-এর ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারকে উপেক্ষা করে এ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সময় হাতে খুব কম। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে হলেও, ধরিত্রী রক্ষায় বেশি অর্থ বরাদ্দের জন্য একমত হতে হবে।

১১ নভেম্বর শুরু হওয়া সম্মেলনে ২০০টি দেশের ৮৫ হাজার প্রতিনিধি তহবিল, অর্থায়ন, অভিযোজন, প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার বিষয়ে বাহাস ও আলাপ জারি রাখেন। তেল উৎপাদনকারী দেশে এমন আয়োজন, বহুজাতিক কোম্পানি প্রতিনিধিদের বিশাল বহর পুরো সম্মেলনকেই সন্দেহ ও বিতর্কে ঠেলে দেয়। তবে পৃথিবীর শীর্ষ ধনী ও সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের নির্লিপ্ততায় সম্মেলন অর্থহীন হয়ে পড়ে। এবার সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য– দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ধনী ও উন্নত দেশগুলো কত অর্থ দিতে সম্মত হবে, তার একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকানোর প্রচেষ্টা চালাবে।

সম্মেলন হতাশার হলেও তহবিল ঘিরে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ‍্যে যেন ঐক্য ভেঙে না যায় এবং কপের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার পক্ষে বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি কপ২৯ প্রেসিডেন্সির নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য (এনসিকিউজি) বিষয়ক সর্বশেষ খসড়া চুক্তির প্রস্তাব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।

সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, এ খসড়া স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ও ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর (সিডস) জরুরি চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব অপ্রতুল। বড় বিষয়, এ বরাদ্দ অনুদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি এবং তা কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার আওতায় নেই। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্বল্পোন্নত ৪৫টি দেশের জন্য বিশেষ তহবিল রাখা হয়নি।

গতকাল বাংলাদেশের গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ বাকু থেকে সমকালকে জানান, সম্মেলন এলাকা ফাঁকা। সবাই চলে যাচ্ছেন। প্যাভিলিয়ন ও প্রদর্শনী হাব শূন্য। সময় এক দিন বাড়লেও শেষ পর্যন্ত সবাইকে শূন্য হাতে হতাশা নিয়ে ফিরতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতির এ গবেষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে আর কতদিন আমরা অপেক্ষা করব? কার্বন দূষণকারী বড় দেশগুলো কেন বারবার মিথ্যাচার করছে? কেন অঙ্গীকার ভাঙছে? ধনী দেশের ভোগ-বিলাসিতার জন্য আমাদের দুর্দশা কেন মেনে নেব?

ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ন্যায্যতা চায়; কোনো দান-দক্ষিণা চায়নি। উত্তরের ধনী দেশের ক্ষমতার বাহাদুরি ও কলোনিয়াল আচরণ বন্ধ করতে হবে। নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোলস (এনসিকিউজি) থেকে কৃষকদের বাদ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যারা দুনিয়ার খাদ্য জোগান, বাকু সম্মেলন তাদের সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারল না। খাদ্য ব্যবস্থা ও কৃষি নিয়ে জোরালো সিদ্ধান্ত ছাড়াই হয়তো শেষ হবে কপ২৯। আবারও ব্রাজিলের বেলেম পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।

সম্মেলনে অংশ নেওয়া ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশের সমন্বয়কারী শরীফ জামিল সমকালকে বলেন, মিসর ও অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তাবের আলোকে শুক্রবার যে খসড়া প্রস্তাব আনা হয়েছে, তা নাগরিকদের আহ্বানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। চীনসহ জি৭৭ জাতির বক্তব্য ও অবস্থানের সঙ্গে এ প্রস্তাব ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য রীতিমতো অবহেলা ও তিরস্কারমূলক। কারণ, নাগরিকদের পক্ষ থেকে বছরে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিলের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতা তুলে ধরা হয়। জি৭৭ও ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের চাহিদা দেয়।

তবে সবকিছু উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত মাত্র ২৫০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাও আবার এ অর্থ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তি খাত থেকে জোগানের প্রস্তাব করা হয়েছে। নাগরিক সংগঠনগুলো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে জলবায়ু সংকটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বল্পোন্নত ও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল সম্মেলনে এলডিসি মন্ত্রী ও ইইউ মন্ত্রীদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ আহ্বান জানানো হয়।

গতকাল কপ২৯ ভেন্যুতে ‘এলডিসি ও এমভিসিভুক্ত দেশগুলোর প্রত্যাশা এবং কপ২৯’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে নতুন জলবায়ু অর্থায়নের ওপর সুস্পষ্ট কর্মকাঠামোর দাবি করেছেন দক্ষিণের দেশগুলোর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা আলোচনাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত ও সমাহিত করার জন্য জি২০ নেতাদের অভিযুক্ত করেছেন। সংবাদ সম্মেলন বাংলাদেশের ইক্যুইটিবিডির প্রতিনিধি আমিনুল হক জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হওয়ায় উন্নত দেশগুলোর নেতাদের সমালোচনা করেন।

আরও পড়ুন

×