দু’দেশের সম্পর্কের অবনতিতে ক্ষতি ভারতেরই
.
সমকাল প্রতিবেদক ও কলকাতা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৫ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৯:৩৮
সম্পর্কের অবনতি হলে বাংলাদেশের চেয়ে ক্ষতি হবে ভারতের। ভারতের ডলার আয়ের অন্যতম উৎস বাংলাদেশ। ফলে ৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের দুই দেশের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভাটা পড়লে ভারতেরই আয় কমবে। রাজনৈতিক কারণে ভারত থেকে উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে। প্রচার পেতে, বাংলাদেশের কাছ থেকে ব্যবসা না পাওয়া অনেক ভারতীয় বয়কটের ডাক দিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে।
ইতোমধ্যে ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। সম্পর্ক আরও বিঘ্নিত হলে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্য, রপ্তানিপণ্যের কাঁচামালে ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। তবে আমদানি এবং চিকিৎসাপ্রাপ্তির বিকল্প থাকায়, বাংলাদেশের ক্ষতি ভারতের তুলনায় কম হবে।
কূটনীতিক এবং ব্যবসায়ীরা সমকালকে এ মূল্যায়ন জানিয়েছেন। তবে তাদের অভিমত, শিগগির রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি না হলেও বাণিজ্যিক সম্পর্কের খুব একটা অবনতির আশঙ্কা নেই। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের অতিরঞ্জিত তথ্য এবং লাগাতার ভুয়া খবর ছড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও বাণিজ্যিক স্বার্থে দেশটির সরকার সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না। গত সোমবার ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে ‘হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি’র নজিরবিহীন হামলায় ভারত সরকার বৈশ্বিক চাপে পড়েছে। এ কারণে নমনীয়তা দেখাতে শুরু করেছে দেশটি।
ব্যবসায়ীদের মূল্যায়ন– ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা বাংলাদেশে খাদ্যপণ্য রপ্তানির বিরুদ্ধে ‘গরম বক্তৃতা’ করলেও, কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় ভারত সরকারের পক্ষে তা মানা সম্ভব নয়। উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়। ভারত পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া লাগালে বাংলাদেশ ওদিকে যাবে না।
বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয়রা নিজ দেশে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের রেমিট্যান্স পাঠান। বাংলাদেশি পর্যটক এবং রোগী ভারতে বছরে বড় অঙ্কের ডলার নিয়ে যান। ভারতীয় ঠিকাদারি এবং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা রয়েছে বাংলাদেশে। এই চার উপায়ে বাংলাদেশ থেকে বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি যায় ভারতে। বিপরীতে ভারত থেকে আসে দুই বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি অর্থ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, ভারত ইস্যুতে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। ভারত থেকে উত্তেজনা দেখালেও বাংলাদেশিরা কেউ কিন্তু সীমান্তে যায়নি, কেউ ভারতীয় হাইকমিশনের দিকে যায়নি। সুতরাং ভারত এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে একভাবে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। তা যে কার্যকর হচ্ছে, এক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহেই স্পষ্ট। বাংলাদেশ শান্ত থাকা এবং ধৈর্য ধারণের যে কৌশল নিয়েছে, এটিই সবচেয়ে উত্তম পথ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, ভারতের রাষ্ট্রদূতকে তলব কিংবা হাইকমিশনের কনস্যুলার সেবা বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়। সময় দিতে হবে, যাতে উত্তেজনা কমে আসে। ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে নানা ধরনের অপতথ্য ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসব যে সঠিক তথ্য নয়, তা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। এ ছাড়া ভারতীয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে, যাতে তারা সঠিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন।ভারতেভা
ব্যবসা পায় না যারা, তারাই বয়কটে
সংবাদমাধ্যমে প্রচার পেতে ভারতের হোটেল ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকরা বাংলাদেশ বয়কটের জিগির তুলেছে। যদিও খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া হওয়া গেছে, বাংলাদেশিরা এসব হোটেল ও হাসপাতালে যান না।
গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশিদের ভাড়া না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ত্রিপুরার হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, গাজীপুর শহরের চেয়েও কম জনসংখ্যার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলাদেশি পর্যটক হাতেগোনা। সোনামসজিদ স্থলবন্দর-সংলগ্ন মালদা জেলাতেও নেই বাংলাদেশি পর্যটক। তাই ক্ষতি হবে না জেনেই প্রচার পেতে বয়কটের ডাক দিচ্ছেন এসব ব্যবসায়ী।
বয়কটের খাতায় নাম লিখিয়েছে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও একজন চিকিৎসক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে বাংলাদেশের রোগীরা চিকিৎসাই নেন না। সেই চিকিৎসকেরও বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা শূন্য।
কলকাতার পর্যটন ব্যবসায়ী দীপক চতুর্বেদী বলেন, বাংলাদেশিরা নির্দিষ্ট কিছু এলাকার ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক। যারা বয়কটের ডাক দিচ্ছে, মনে হয় তাদের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে; যেহেতু তারা বাংলাদেশিদের থেকে ব্যবসা পায় না।
কলকাতার নিউমার্কেট বাংলাদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। এখানকার ব্যবসায়ীরা বয়কটের ডাক দেননি। নিউমার্কেট হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এ এলাকায় দুই শতাধিক হোটেল ও শতাধিক মানি এক্সচেঞ্জার। রেস্তোরাঁ ব্যবসা থেকে পরিবহন, পর্যটন সবই বাংলাদেশি পর্যটকনির্ভর। এ এলাকায় বাংলাদেশিদের অতিথির আপ্যায়ন করা হয়, বয়কটের প্রশ্নই আসে না।
নিউমার্কেট এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী মনোজিৎ দে অভিযোগের সুরে বলেন, কিছু মানুষ হিংসার বশবর্তী হয়ে সম্পর্ক খারাপ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাঁর দাবি, বাংলাদেশিরা নিশ্চিন্তে কলকাতায় ভ্রমণ করুক।
দুই দেশের সম্পর্কে শীতলতায় সবচেয়ে চাপে পড়েছেন ভারতীয় রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশের সঙ্গে ৩০ বছরের বেশি সময় ব্যবসা করা বঙ্কিম প্রধান বলছেন, ব্যবসায়িকভাবে অসফল মানুষরাই বয়কটের খেলায় মেতেছে।
ভারতীয় চেম্বার অব কমার্সের এই সিনিয়র সদস্য বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের ওপর ভারতের হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা নির্ভর করে। বাংলাদেশ ভারতের রেমিট্যান্সের অন্যতম উৎস। বছরে অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলার আসে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ উপার্জন করে ভারতীয়রা নিজ দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছেন।
ভারতের বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত বাংলাদেশি রোগীর ওপর নির্ভরশীল। কলকাতা ও চেন্নাইয়ের বড় হাসপাতালগুলোর জনসংযোগ কর্মকর্তারা জানান, বয়কট ঘোষণা ব্যবসার খুবই ক্ষতি করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, চিকিৎসা ক্ষেত্রে বয়কটের কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। পাকিস্তানি নাগরিকরাও যেখানে নির্দ্বিধায় চিকিৎসা করাতে আসেন, সেখানে বাংলাদেশি চিকিৎসাপ্রত্যাশীরা আমাদের বন্ধু।
চেন্নাইয়ের আরেক হাসপাতালের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ভারতীয় রোগীরা হয় সরকারি হাসপাতালে কিংবা সরকারি বীমায় চিকিৎসা করান। বাংলাদেশিরা চিকিৎসা নেন নগদ টাকায়, যা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নগদ অর্থের চাহিদা মেটায়।
কার কত ক্ষতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত থেকে ৯৪ হাজার ৩৩ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১৬ হাজার ৯৮২ কোটি টাকার পণ্য। ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ইবিসিসিআই) সিনিয়র সহসভাপতি শোয়েব চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের পণ্য আমদানির দ্বিতীয় উৎসস্থল ভারত। প্রতিবেশী বলে স্থলপথে কম সময়ে আমদানি করা যায়। তাই ভারতকেই প্রাধান্য দেন ব্যবসায়ীরা। গত ৫ আগস্টের পর আমদানি কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। রপ্তানি কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। যদিও নভেম্বরে রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে।
তিনি আরও জানান, ভারত থেকে আমদানির বড় অংশই পোশাক শিল্পের কাঁচামাল। যেমন– তুলা, সুতা ও রাসায়নিক পণ্য। আমদানি কমলে পোশাক খাতে প্রভাব পড়তে পারে। দুই দেশের স্বার্থ জড়িত বলে রাজনৈতিক আলোচনায় সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।
ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়রম্যান তাসকিন আহমেদ বলেন, ভারত থেকে আমদানিতে পরিবহন খরচও কম। তবে ব্যবসায়ীরা যেখানে কম দাম পাবেন, সেখান থেকেই আমদানি করবেন।
দুই দেশের রপ্তানির চিত্র তুলে ধরেন ইবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি। তিনি বলেন, বছরে ১৩ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয় ভারত থেকে। বিপরীতে রপ্তানি হয় ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। তবে ইনফরমাল ট্রেড অর্থাৎ চোরাইপথে বাংলাদেশে অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ভারত থেকে আসে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সম্পর্কের অবনতিতে তাই ভারতেরই ক্ষতি বেশি। অনিশ্চয়তা থাকায় এ বছর ভারতের বদলে মিসর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। গত মাসেই পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়েছে পোশাক খাতের কাঁচামাল ও রাসায়নিক।
চিকিৎসা খাতের কী হবে
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম (বিওটিওএফ) সূত্র জানায়, প্রতি বছর গড়ে আট লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। এর বড় অংশই যায় ভারতে। দ্বিতীয় প্রধান গন্তব্য থাইল্যান্ড। তৃতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর। প্রতি বছর বিদেশে চিকিৎসা নিতে খরচ হচ্ছে ৪ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ভারতে যে চিকিৎসা হয়, তা বাংলাদেশেও হয়। করোনার সময় দুই দেশের ভিসা বন্ধ ছিল, সে সময়ে সবাই বাংলাদেশেই চিকিৎসা নিয়েছেন। এর জন্য মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার রেকর্ড নেই। ভারত ভিসা না দেওয়ায় আতঙ্কিত ও উদ্বেগের কিছু নেই। চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করলে বাংলাদেশেই ভারতীয় মানের চিকিৎসা সম্ভব। বরং ভারতই আয় বঞ্চিত হবে। শ্রীলঙ্কা, নেপালেরও কেউ ভারতে যায় না চিকিৎসার জন্য।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, বিদেশে পর্যটক হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি সাড়ে ২৯ শতাংশ চিকিৎসা বাবদ ব্যয় করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের বাইরে এই ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা।
ভারতের এখনও প্রচারণা
দিল্লি সরকার নমনীয়তা দেখাতে শুরু করলেও ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও উত্তেজনা দেখাচ্ছে। গতকাল দেশটির রাজ্যসভায় কয়েকজন এমপি বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানোর কথা বলেন।
যদিও ত্রিপুরা সরকার সোমবারের হামলার ঘটনায় গতকাল সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হামলার নিন্দা জানিয়েছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা। আগে সীমান্তে বিশৃঙ্খলা করা হলেও গতকাল এমন কিছু ঘটেনি। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ এলাকার আট জেলার বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে ভারত।
- বিষয় :
- ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত