ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

বিআইজিডির জরিপ

৩৮% মানুষ এখনও সিদ্ধান্ত নেননি কাকে ভোট দেবেন

বিএনপিকে ১৬%, জামায়াতকে ১১% জাপাকে ১% মানুষ ভোট দেবেন

৩৮% মানুষ এখনও সিদ্ধান্ত নেননি কাকে ভোট দেবেন

কোলাজ

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:০৩ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০:০৪

দেশে এখন নির্বাচন হলে কোন দলকে ভোট দেবেন– সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেননি ৩৮ শতাংশ মানুষ। বাকি মানুষের ১৬ শতাংশ বিএনপিকে, ১১ শতাংশ জামায়াতে ইসলামীকে এবং ৯ শতাংশ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া ৩ শতাংশ মানুষ অন্য ইসলামী দলগুলোকে ও ১ শতাংশ জাতীয় পার্টিকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করলে তাদের ভোট দেবেন ৪০ শতাংশ মানুষ (৩৯ শতাংশ পুরুষ, ৪৪ শতাংশ নারী)। ভোট দেবেন না বলে জানিয়েছেন ৪৪ শতাংশ মানুষ (৪৭ শতাংশ পুরুষ, ৩৬ শতাংশ নারী)।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘পালস সার্ভের’ দ্বিতীয় ধাপের জরিপের ফলাফলে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে (পিআইবি) এক অনুষ্ঠানে এ ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বিআইজিডির আয়োজনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ : মানুষ কী ভাবছে’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা সহযোগী শেখ আরমান তামিম জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। পরে ফলাফল নিয়ে একটি গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়। 

এ বছরের অক্টোবরে পরিচালিত ‘পালস সার্ভে দ্বিতীয় ধাপ: অক্টোবর ২০২৪’ জরিপে দেখা যায়, উত্তরদাতাদের ৫৬ শতাংশ বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে। অন্যদিকে ৩৪ শতাংশ মনে করেন, দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। এ ফলগুলো গত আগস্টে করা পালস সার্ভের প্রথম ধাপে পাওয়া ফলাফলের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। পূর্ববর্তী জরিপের উত্তরদাতাদের ৭১ শতাংশ দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন ১২ শতাংশ মানুষ।

এ জরিপে দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে যাচ্ছে কিনা, জানতে চাইলে ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন সঠিক পথে রয়েছে। ৫২ শতাংশ মনে করেন, অর্থনীতি সঠিক পথে চলছে না। অর্থাৎ অর্থনীতি নিয়ে জনগণের আশাবাদ গত আগস্টের তুলনায় অক্টোবরে এসে কমে গেছে। গত আগস্টে ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেছিলেন দেশ সঠিক পথে যাচ্ছে, আর ২৭ শতাংশ মনে করেছিলেন ভুল পথে যাচ্ছে।

অক্টোবরের জরিপে দেখা যায়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে জনসাধারণের মতামতে বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে। ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা আগস্টে বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দু’দিক থেকেই দেশ সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশ। আগস্টে ১৭ ভাগ উত্তরদাতা মনে করতেন দেশ ভুল পথে যাচ্ছিল। এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশ। 

দেশবাসী মনে করেন, দেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু। ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা মূল্যবৃদ্ধি, মন্দাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যাকে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন এক দফায় পরিবর্তিত হওয়ার ব্যাপারে জনগণের সমর্থন কতটুকু স্থানান্তরিত হয়েছে, তা বোঝার জন্য জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, আগস্টে ৮৩ শতাংশ মানুষ আন্দোলনকে সমর্থন করলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এসে এ সমর্থন দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। আগস্টে ১০ ভাগ মানুষ বলেন, তারা এ আন্দোলনকে সমর্থন করেননি, যা অক্টোবরে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশ। 

দেশের মধ্যকার সহনশীলতার কী অবস্থা, তা জানতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামত নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, সহনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন সহনশীলতা কমেছে এবং ২০ শতাংশ বলেছেন সহনশীলতার ব্যাপারটি অভ্যুত্থানের আগে যেমন ছিল, তেমনই আছে। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৪০ শতাংশ মনে করেন, এ সরকারকে কমপক্ষে দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে। ৪৬ শতাংশ মনে করেন এক বছর বা এর কম সময়ই যথেষ্ট। তিন বছর বা এর বেশি সময়ের জন্য এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে জনসমর্থন আগের তুলনায় কমে এসেছে। আগস্টে ৩৮ শতাংশ যেখানে এই তিন বছর মেয়াদকে সমর্থন করেছিলেন, অক্টোবরে তা কমে হয়েছে ২৪ শতাংশ। ৫ শতাংশ মনে করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত অবিলম্বে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া।

বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বর্জনের ব্যাপারেও সমীক্ষায় জানতে চাওয়া হয়। ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সরকার জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। ২৪ শতাংশ মনে করেন, সরকার নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি এবং ২১ শতাংশ মনে করেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথাযথ চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি। আবার, সরকার কি দৃঢ়ভাবে দেশ চালাচ্ছে– এই প্রশ্নের জবাবে ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, হ্যাঁ; সরকার দৃঢ়ভাবে দেশ চালাচ্ছে। কিন্তু ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতা এই মতের বিপক্ষে।

৭৯ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন, নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চেয়ে দেশ ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারে। ১৫ শতাংশ এই মতের বিপক্ষে।

অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কাজের প্রচেষ্টা কেমন, তাতে ১০০ নম্বরের মধ্যে কত দেবেন, জানতে চাওয়া হয়েছিল জরিপে। ৪০ শতাংশ মানুষ সরকারকে ৮১ থেকে ১০০ নম্বর দিয়েছেন। ৬১ থেকে ৮০ নম্বর দিয়েছেন ২১ শতাংশ, ৪১ থেকে ৬০ নম্বর দিয়েছেন ১৯ শতাংশ আর ২১ থেকে ৪০ নম্বর দিয়েছেন ৭ শতাংশ মানুষ। সরকারকে শূন্য থেকে ২০ নম্বর দিয়েছেন ১৩ শতাংশ মানুষ। অবশ্য গত আগস্টে সরকারকে ৮১ থেকে ১০০ নম্বর দিয়েছিলেন ৪৮ শতাংশ মানুষ।

জরিপে গ্রাম ও শহরের নানা শ্রেণি-পেশার ৪ হাজার ১৫৮ মানুষের মতামত নেওয়া হয়। তাদের ৫৩ শতাংশ পুরুষ, ৪৭ শতাংশ নারী; ৫১ শতাংশ গ্রামের ও ৪৯ শতাংশ শহুরে। গত ১৫ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এ জরিপ চালানো হয়। এর আগে সেপ্টেম্বরে বিআইজিডির পালস সার্ভের প্রথম ধাপের ফল প্রকাশ করা হয়েছিল।

অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও অনেকেই এখনও আর্থিক দুরবস্থায় বাস করছেন এবং আবারও দারিদ্র্যের চক্রে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে আরও জোরদার ও বিস্তৃত করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব।’

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মাত্র চার মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত সময়কালে একাধিক জটিল সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন বটে। তবে আমরা সবাই মিলে দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বিআইজিডি সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের পর আগস্টে মানুষের আশা বেড়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই আশা পূরণ না হওয়ায় জনসাধারণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সময় সরকারকে জনগণের এই উদ্বেগের কথা বিবেচনা করতে হবে।

পিআইবির চেয়ারপারসন অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম বলেন, অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও আমার অনেক ছাত্রী বলেছে, তারা এখন পাবলিক প্লেসে নিরাপদ বোধ করছে না। নারীদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। এ সমস্যা সমাধানে আমাদের একটি নতুন শক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, জনগণ  সরকারের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা চায়, যাতে তারা বুঝতে পারে সরকার কীভাবে এবং কী কী কাজ করে দেশের উন্নতি করবে।

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ জানান, এই সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। অভ্যুত্থানের পর জনগণের উচ্ছ্বাস তাদের প্রত্যাশাকেও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার কারণে জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জনমনে এত প্রত্যাশা জন্মানোর পেছনে সরকারের বার্তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এই বার্তা পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।

 

আরও পড়ুন

×