ঢাকা সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

নাবিলের ঋণের বোঝা কর্মচারীদের কাঁধে

নাবিলের ঋণের বোঝা কর্মচারীদের কাঁধে

ওবায়দুল্লাহ রনি

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৫ | ০২:৫৪ | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫ | ০৯:২০

নজরুল ইসলাম ও নাজমুল হাসান নাবিল গ্রুপের কর্মী। তারা যথাক্রমে ৪১ হাজার ২০ এবং ২৯ হাজার ৫৩৮ টাকা করে বেতন পান। একই সঙ্গে তারা আনোয়ার ফিড মিলস নামের একটি কোম্পানির মালিক। নাবিলের এই দুই কর্মচারীর কোম্পানিকে ১ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক।

নাবিল গ্রুপের এমন ১৪ কর্মী ও সুবিধাভোগীর নামে খোলা ৯টি কোম্পানিকে ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এই ১৪ জনের সবাই নাবিল গ্রুপ থেকে প্রতি মাসে বেতন ও সম্মানী পান। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন, এই বেনামি ঋণের সুবিধাভোগী মূলত নাবিল গ্রুপ। এর মধ্যে নাবিল গ্রেইন ক্রপস নামে একটি কোম্পানির মালিক গ্রুপটির কর্মী শাকিল হোসেন ও রায়হানুল ইসলাম। নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও এ কোম্পানিতে আছেন। কোম্পানির নামের সঙ্গে নাবিল শব্দটি থাকলেও গ্রুপের ওয়েবসাইটে কোম্পানিটির নাম রাখা হয়নি। এই কোম্পানিকে ১ হাজার ৭৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। 

রাজশাহীভিত্তিক দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নাবিল গ্রুপ। ইসলামী ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির নামে-বেনামে মোট ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। এই ঋণের প্রায় পুরোটা দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, বিশেষত ২০২২ সালে। এসব ঋণ ফেরত আসছে না; আবার অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়েও তা খেলাপি হচ্ছে না।

নাবিল গ্রুপের কর্ণধার আমিনুল ইসলাম স্বপন। বর্তমান সরকারের সময়ে গ্রুপটি দেশের চতুর্থ বৃহত্তম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২২ ও ২০২৩ সালে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে এর অবস্থান ছিল পঞ্চম।

ব্যবসায়ী স্বপনের এই শক্তির উৎস খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, গত ১৮ জানুয়ারি রাজশাহীতে জামায়াতে ইসলামীর সম্মেলন মঞ্চে নেতাদের সঙ্গে তাঁকে দেখা গেছে। এ নিয়ে সমালোচনা হলে রাজশাহী মহানগরী জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা কেরামত আলী এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, তাঁর অজ্ঞাতসারে নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান মঞ্চে উঠে পড়েন। তিনি জামায়াতের কোনো পর্যায়ের কর্মী নন।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শেখ হাসিনার পরিবার এবং ১০টি ব্যবসায়ী গ্রুপের ব্যাংক জালিয়াতি, অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে চারটি সরকারি সংস্থার সমন্বয়ে ১১টি কমিটি করা হয়। এই ১০ কোম্পানির তালিকায়ও নাবিল গ্রুপের নাম আছে। 

আবার সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে গত সেপ্টেম্বরে নাবিল গ্রুপের এমডি আমিনুল ইসলাম, স্ত্রী মোছা. ইসরাত জাহান, পিতা নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান জাহান বক্স মণ্ডল, মা ও গ্রুপের পরিচালক আনোয়ারা বেগম, দুই সন্তান এজাজ আবরার ও আফরা ইবনাথের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে তাদের কোম্পানির হিসাব পরিচালনায় বাধা নেই। 

ঋণসীমা লঙ্ঘন

ইসলামী ব্যাংক সূত্র জানায়, নাবিল গ্রুপের এসব প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকের বর্তমান ঋণ স্থিতি অনুমোদিত সীমার ওপরে চলে গেছে। সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করার পরও ব্যাংক তাদের আরও ঋণ দেওয়ায় এই সীমা অতিক্রম হয়। ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় এসব কোম্পানির ঋণসীমা ৮ হাজার ১১২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ২০ মার্চ পর্যন্ত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে নাবিল গ্রুপের কর্ণধার আমিনুল ইসলাম স্বপন গতকাল রাতে সমকালকে বলেন, ‘একটা পিওনের নামে চাইলেই কি আপনি ঋণ নিতে পারবেন? একটা ঋণের জন্য অনেক ধাপ পেরোতে হয়। সুতরাং, ইসলামী ব্যাংক কেন তাদের নামে ঋণ দিল, সেই ব্যাখ্যা আগে চাওয়া উচিত।’ 

বেনামি হিসেবে চিহ্নিত ৯ প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুবিধাভোগী নাবিল গ্রুপ কিনা–জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘অবশ্যই না। ব্যাংক যদি বলে এসব ঋণের সুবিধাভোগী নাবিল গ্রুপ, তাহলে আমি পুরো ঋণ পরিশোধ করে দেব।’

এই ৯ কোম্পানির ১৪ মালিক নাবিল গ্রুপ থেকে প্রতি মাসে বেতন বা সম্মানী পাওয়ার তথ্য উপস্থাপন করলে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ধরুন, আমার প্রতিষ্ঠানের পিওনের নামে ইসলামী ব্যাংক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। কেন ঋণ দিল, সেটি ইসলামী ব্যাংকই ভালো বলতে পারবে।’ 

ইসলামী ব্যাংকের বক্তব্য নেওয়ার জন্য গত কয়েক দিন চেষ্টার পরও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফোন ধরেননি। ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এর পর এমডির হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠানো হয়– নাবিল গ্রুপের ১৩ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা বেনামি ঋণ। এই ঋণের বিষয়ে এমডি হিসেবে তাঁর দায় আছে কিনা? জবাবে তিনি লিখেছেন–‘টোটালি ফলস’–মানে ডাহা মিথ্যা।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী একটি ব্যাংক তার মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ একক ব্যক্তি বা গ্রুপকে ঋণ দিতে পারে। এর মধ্যে ফান্ডেড তথা সরাসরি ঋণ দেওয়া যায় ১৫ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংক এখন মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। এর আগে ব্যাংকটির ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন ছিল। ওই সময় একক গ্রাহককে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সুযোগ ছিল। নাবিল গ্রুপকে নামে-বেনামে এর পাঁচ গুণের বেশি ঋণ দেওয়া হয়। 

সূত্র জানায়, ব্যাংকটির ভেতরে নানা পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। অথচ নাবিলের ঋণ আদায়ে কোনো উদ্যোগ নেই। গত ৫ আগস্টের পর নাবিল গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকে ৩০০ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। এই অর্থ দেওয়া হয়েছে সমপরিমাণ অর্থের এলসি খোলার শর্তে। এর বাইরে কোনো অর্থ জমা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ঋণ উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপের কথা শোনা যায়নি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান অবশ্য সমকালকে বলেন, যে কয়েকটি ব্যাংক থেকে ফরেনসিক অডিট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে তালিকায় রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। সেখানে নাবিল গ্রুপসহ যার যত ধরনের অনিয়ম হয়েছে, গুরুত্ব বিবেচনায় প্রতি ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যে ঋণের শ্রেণিমান যা, অবশ্যই তা দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক ছাড় পাবে না। তবে নিয়ম মেনে কেউ কিস্তি পরিশোধ কিংবা পুনঃতপশিল করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেখানে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।

নিজ নামে ঋণ ৪০৮০‍ কোটি টাকা

নাবিল গ্রুপ মূলত উত্তরাঞ্চলে ভোগ্যপণ্য সরবরাহের জন্য পরিচিত ছিল। বেশ আগ থেকে গ্রুপটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক হলেও হঠাৎ করে ঋণ বেড়েছে ২০২২ সালের মার্চের পর। ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় নাবিল গ্রুপের নামে বর্তমানে ঋণ রয়েছে ২ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। আর নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান জাহান বক্সের নামে নিবন্ধিত এ জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ঋণ আছে ১ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। ঋণটি বর্তমানে সাবস্ট্যান্ডার্ড ও সন্দেহজনক মানে শ্রেণীকৃত হয়ে আছে। এর মানে নাবিল পরিবারের নামে এখন ঋণ রয়েছে ৪ হাজার ৮০ কোটি টাকা।

২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় নাবিল গ্রুপের মোট ঋণ ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ওই বছর শেষে এসে ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা ও রাজশাহীর ছয়টি শাখায় বেনামিসহ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। 

নাবিল গ্রুপের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৫টি। নাবিল ট্রেডিং, এনজিআই ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নাবিল ফিড মিলস, শিপুল এন্টারপ্রাইজ, আইএনএনএ এগ্রোটেক, নাবা ক্রপ কেয়ার, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলস, নাবিল অটো রাইস মিলস, নাবিল ডাল মিলস, নাবিল এডিবল অয়েল, ফুডেলা 
ব্র্যান্ডের ভোগ্যগণ্য, নাবিল ট্রান্সপোর্ট, নাবিল কোল্ড স্টোরেজ, রেজা কোল্ড স্টোরেজ এবং অনুরা-জাহান বক্স ফাউন্ডেশন। 

নাবিল গ্রেইন ক্রপসসহ কর্মচারীদের নামে খোলা কোম্পানিগুলোর নাম এই ওয়েবসাইটে নেই। এ কারণে এ কোম্পানিগুলোর নামে নেওয়া ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার ঋণকে বেনামি বলছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। 

বেনামে যত ঋণ

ইসলামী ব্যাংকের ঢাকার গুলশান করপোরেট শাখা থেকে নাবিল গ্রেইন ক্রপস নামে ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। অনুমোদিত ঋণসীমা অবশ্য ৯৬৬ কোটি টাকা। ব্যাংকের নথিতে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা বনানীর ডি ব্লকের ৯ নম্বর প্লটের ১৭ নম্বর রোডের নাবিল হাউস। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় রয়েছেন শাকিল হোসেন, মোহাম্মদ রায়হানুল ইসলাম ও আমিনুল ইসলাম স্বপন। 

ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানায়, শাকিল হোসেন ও রায়হানুল ইসলাম মূলত নাবিল গ্রুপের কর্মচারী। গ্রুপটির কর্মীদের বেতন যায় ব্যাংকের রাজশাহী শাখায়। অন্য কর্মীদের মতো শাকিল ও আনোয়ারের বেতনও যায় এ শাখায়। হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে দু’জনেরই বেতন বেড়েছে। 

জানতে চাইলে রায়হানুল ইসলাম গত রোববার সন্ধ্যায় টেলিফোনে সমকালকে বলেন, ট্রেডিং ব্যবসার জন্য এ প্রতিষ্ঠানের নামে তিনিসহ কয়েকজন মিলে ঋণ নিয়েছেন। নাবিল গ্রুপের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতি মাসে তাঁর ব্যাংক হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, ‘একসময় নাবিল গ্রুপে চাকরি করতাম।’ মার্চেও তাঁর ব্যাংক হিসাবে বেতনের সমপরিমাণ টাকা যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সম্মানী হিসেবে নাবিল গ্রুপ থেকে প্রতি মাসে একটা অর্থ পাই।’

ব্যাংকের রাজশাহী শাখার আরেক গ্রাহক আনোয়ার ফিড মিলস। ব্যাংকের নথিতে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে নাম রয়েছে নজরুল ইসলাম ও নাজমুল হাসানের। তারা দু’জনই নাবিল গ্রুপের কর্মচারী। আনোয়ার ফিড মিলসের ঋণ স্থিতি এখন ১ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপের অ্যাকাউন্ট থেকে নজরুলের ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী নিউমার্কেট শাখার অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ৪১ হাজার ২০ টাকা এবং নাজমুলের হিসাবে দেওয়া হয় ২৯ হাজার ৫৩৮ টাকা।

রোববার টেলিফোন করা হলে নজরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে দু’রকম তথ্য দেন। প্রথমে তিনি জানান, এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তাঁর। তাঁর অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে নাবিল গ্রুপ থেকে বেতন আসার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা নাবিল গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। আমি এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি।’

ইসলামী ব্যাংকের গুলশান সার্কেল-১ শাখায় মার্কেট মাস্টার এনালাইজার নামে নাবিলের আরেকটি বেনামি প্রতিষ্ঠানের ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। ৯৫০ কোটি টাকা ঋণসীমার বিপরীতে এ অর্থ দেওয়া হয়। ব্যাংকের নথিতে মার্কেট মাস্টার এনালাইজারের অফিসের ঠিকানা উল্লেখ আছে ঢাকার বনানীর ১৭ নম্বর রোডের ১৩ নম্বর বাড়ি। নাবিল গ্রুপের ঢাকার অফিসও এ বাড়িতে। এই কোম্পানি নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে শফিকুল ইসলাম ও শাহ আলমের নামে। শফিকুলের নামে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখার হিসাবে বেতন যায় প্রতি মাসে ২৪ হাজার ৯১৬ টাকা এবং শাহ আলমকে দেওয়া হয় ১৯ হাজার ৫৪৯ টাকা।

আরেক বেনামি প্রতিষ্ঠান জামান সিন্ডিকেট ইসলামী ব্যাংকের পাবনা শাখার গ্রাহক। প্রতিষ্ঠানটির ৯৭৩ কোটি টাকার অনুমোদিত সীমার বিপরীতে ঋণ স্থিতি রয়েছে ১ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধিত মো. রোকনুজ্জামান মিঠুর নামে। তিনিও নাবিল গ্রুপের কর্মচারী। তাঁর নামেও ব্যাংকের রাজশাহী শাখার হিসাবে প্রতি মাসে নাবিল গ্রুপ থেকে ২৪ হাজার ৯৭ টাকা যাচ্ছে। 

দুই ভাইকে মালিক সাজিয়ে আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ

ব্যাংকের রাজশাহী শাখার গ্রাহক আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটির ৯৪১ কোটি টাকা অনুমোদিত ঋণসীমার বিপরীতে বর্তমান ঋণ স্থিতি রয়েছে ১ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আনোয়ারা ট্রেডের নিবন্ধন রয়েছে আনোয়ার ইসলামের নামে। নাবিল গ্রুপ থেকে তাঁর নামেও প্রতি মাসে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখার অ্যাকাউন্টে ৪০ হাজার ১০৯ টাকা দেওয়া হয়।

হারুন উর রশিদ ও মামুন অর রশিদের নামে নিবন্ধিত নাবা ফার্ম এবং নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ইসলামী ব্যাংকের দুটি শাখা থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। হারুন আনোয়ার ইসলামের ভাই। ব্যাংকটির রাজশাহী শাখা নাবা ফার্মের নামে ৫৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। গুলশান করপোরেট শাখা থেকে নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে আরও ৭৫৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। 

ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় হারুনের নামে থাকা অ্যাকাউন্টেও নাবিল গ্রুপ থেকে প্রতি মাসে ২৭ হাজার এবং মামুনের অ্যাকাউন্টে ৩১ হাজার ১০ টাকা দেওয়া হয়। 
হারুনউ র রশিদ গত রোববার টেলিফোনে সমকালকে বলেন, প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকানা তাঁর। এই ঋণও তিনি নিয়েছেন। এর পরের প্রশ্ন করতেই অসুস্থতার কথা বলে ফোন কেটে দেন। পরে আবার ফোন করলে রেগে গিয়ে বলেন, ‘বললাম না অসুস্থ, কথা বলতে পারব না।’ কিছুক্ষণ পর নিজেই আবার ফোন করেন। কোন প্রতিষ্ঠানের নামে কত টাকা ঋণ– জানতে চাইলে জানেন না বলে জানান। নাবিল গ্রুপ থেকে প্রতি মাসে টাকা পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘প্রতি মাসে সম্মানী হিসেবে টাকা পাই।’

কৃষক ও দোকানদারের নামে বের করা হয়েছে ২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা

ব্যাংকটির রাজশাহী শাখার গ্রাহক ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্ট প্যালেস। এ শাখায় প্রতিষ্ঠানটির ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। কোম্পানিটির নিবন্ধন নাবিলের কর্মী মুখলেছুর রহমানের নামে। মুখলেছুরের সঞ্চয়ী (ফার্মার) হিসাবে কখনও নগদে, কখনও নাবিল গ্রুপ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা যায় প্রতি মাসে। সর্বশেষ মার্চে নগদে ৩০ হাজার টাকা জমা হয়। এর আগে গত জুলাই পর্যন্ত বেতন হিসেবে নাবিল গ্রুপের হিসাব থেকে স্থানান্তর হচ্ছিল ৩২ হাজার ২৬৪ টাকা।

সুলতান অ্যাসোসিয়েটসের নামে ব্যাংকের রাজশাহী নিউমার্কেট শাখায় ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। নাবিলের কর্মচারী সুলতান আহমাদের নামে এই কোম্পানিটির নিবন্ধন। সম্প্রতি একে লিমিটেড কোম্পানি করা হয়েছে। এতে পরিচালক হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আতাবুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী শাহিনুরকে। গত বছরের এপ্রিল থেকে আতাবুলের ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে নগদে ২৫ হাজার টাকা করে জমা দিচ্ছেন নাবিল গ্রুপের কর্মচারী রবিউল। 

সার্বিক বিষয় শুনে অভিজ্ঞ ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন সমকালকে বলেন, এসব ঋণ সৃষ্টির বিষয়টি ছিল পূর্বনির্ধারিত। এ কারণে কার নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা বিষয় ছিল না। তিনি বলেন, ব্যাংকের পুরো প্রক্রিয়া এই ঋণ সৃষ্টি করেছে। আবার নিয়ম না মানার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কোনো পক্ষ এই দায় এড়াতে পারে না। 

আরও পড়ুন

×