পিপিআরসি-বিআইজিডি জরিপ
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশে নতুন দরিদ্র ৩ কোটি ৩০ লাখ

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ০৮:২৭ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ০৮:৩৯
গ্রাম এবং শহরের বস্তির যেসব ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার গড়ে কম আয় করলেও করোনার আগে দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, তারা লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিবারের দুই-তৃতীয়াংশই আগস্টে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এদের বাংলাদেশের 'নতুন দরিদ্র' জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জীবন ও জীবিকা নিয়ে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) পরিচালিত আগস্টের এক জরিপের ফলাফল অনুযায়ী বর্তমানে জাতীয় জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী 'নতুন দরিদ্র'। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরলে এ সংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লাখ।
বৃহস্পতিবার ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে আনুষ্ঠানিকভাবে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ২০২০ সালের এপ্রিলে দেওয়া প্রথম লকডাউনের ধাক্কা ধীরগতিতে হলেও সামলে উঠছিল শহরের বস্তিবাসী এবং গ্রামবাসী। আগস্টে শহুরে বস্তি এবং গ্রাম মিলিয়ে ৪ হাজার ৮৭২ পরিবারের ওপর পিপিআরসি ও বিআইজিডির জরিপে চতুর্থ ধাপের জরিপে দেখা গেছে, সর্বশেষ লকডাউনের ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার হার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর আগের ধাপের জরিপগুলো যথাক্রমে ২০২০ সালের এপ্রিল, জুন এবং চলতি বছরের মার্চ মাসে করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে জানানো হয়েছে, অনেক পরিবার দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্যে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মহামারি আসার পর দারিদ্রসীমার ওপরে অবস্থানরত অন্তত ২৯ শতাংশ পরিবার দরিদ্র হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের অবস্থান এখনও উন্নত করতে পারেনি। দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্যের কারণে পরিবারগুলোর স্বাভাবিক জীবিকা ব্যাহত হতে পারে এবং তারা দারিদ্রের দুষ্টচক্রে পড়তে পারে।
জরিপে দেখা গেছে, এ বছরের মার্চের তুলনায় শহরের বস্তিবাসী এবং গ্রামবাসীর আয় যথাক্রমে ১৮ এবং ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে, যা পুনরুদ্ধারের ধারার বিপরীত। সর্বশেষ লকডাউনে প্রায় অর্ধেকই তাদের জীবিকার সংকটের কথা জানিয়েছেন। স্বল্পশিক্ষিত ও দরিদ্রদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জানিয়েছেন, তারা প্রত্যাশিত কাজ পাননি। প্রথম লকডাউনে ৪৫ শতাংশ পরিবার সামান্য ত্রাণ পেলেও দ্বিতীয় লকডাউনে তা নেমে এসেছে ২৩ শতাংশে। ফলে জীবিকার যে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান ছিল, তা কিছুটা ঘুরে গেছে এবং আগস্টে মানুষের আয় করোনার আগের তুলনায় ২৩ শতাংশ কমেছে।
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নতুনভাবে সংক্রমণের ঢেউ আসার হুমকি এখনও বিদ্যমান। স্বাস্থ্যসেবা, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক নীতিমালার সমন্বয়ে একটি সার্বিক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে কিছুতেই এ ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। শহরে বড় আকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং সিএসএমই পুনরুদ্ধারে বাজেটসমৃদ্ধ পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবায়, শিক্ষায়, যাতায়াতে ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যয়বৃদ্ধিকে মাথায় রেখে সামষ্টিক নীতিমালা তৈরির দিকে নজর দিতে হবে।
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, আমাদের এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষত নতুন দরিদ্রদের দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্যের কবলে পড়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আমাদের অবশ্যই পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে পড়ার দিকে এখনই নজর দিতে হবে।
জরিপে আরও দেখা যায়, কাজ এবং আয়ের অনিশ্চয়তায় ১৮ মাসে মানুষের জীবনযাপনের ঝুঁকি বেড়েছে। জীবনযাপনের জন্য অনেকেই পেশা পরিবর্তনের মাধ্যমে আয়ের চেষ্টা চালিয়েছে। এমনকি তারা তাদের দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন কাজেও নিয়োজিত হয়েছিল। ১৭ শতাংশ দক্ষ কর্মী দিনমজুরের মতো অদক্ষ কর্মী হিসেবেও কাজ করছেন। মহামারিতে ঋণের পরিমাণও বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। মহামারির আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঋণের পরিমাণ তাদের বার্ষিক আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ থাকলেও চলতি বছরের আগস্টে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, বিশেষত শিশুদের ওপর এমন অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। শহরের ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে গ্রামে কিংবা তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল শহরে চলে যাওয়া ১০ শতাংশ বস্তিবাসী এখনও ফিরে আসেনি। জরিপে অংশগ্রহণকারী পরিবারে দারিদ্র্যের হার মহামারি পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ১৭ শতাংশীয় পয়েন্ট ওপরে অবস্থান করছে এবং শহুরে বস্তিতে এ হার ২২ শতাংশ। দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে বর্তমানে শহরের বস্তির ৭৭ শতাংশ পরিবার দরিদ্র, যা উদ্বেগজনক।
- বিষয় :
- দারিদ্র্যসীমা
- পিপিআরসি
- বিআইজিডি
- জরিপ