পবিত্র ঈদুল আজহা
ভয় পাওয়া-না পাওয়ার উৎসব

মোহীত উল আলম
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২১ | ১২:০০
বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত কয়েকদিন ধরে দুইশর ওপরে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় পশুর হাটগুলোতে যে জনসমাগম দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু ভয়াবহ বার্তা দেয়। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সপ্তাহখানেকের জন্য শিথিল করা বিধিনিষেধ কী পরিণাম ডেকে আনে জাতির জন্য, সেটি মহা উদ্বেগের ব্যাপার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। মৃত্যুহার বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে তখন কী হবে! সবচেয়ে ভয় হয় কল্পনা করতে যে, রাস্তায় লোক মরে পড়ে থাকবে কিনা!
মানুষের মনে সাধারণভাবে মৃত্যুচিন্তা সব সময় ক্রিয়াশীল। সচেতন যে কোনো মানুষই জানে, যে কোনো সময়েই তার মৃত্যু আসতে পারে। আমার বন্ধু লেখক ও অধ্যাপক নুরুল করিম নাসিম সব সময় আড্ডার শুরুতে বলতেন, 'ব্রাদার, ডেথ ক্যান কাম অ্যানি টাইম, সো এভরি ডে ইজ ইয়োর লাস্ট ডে।' বড়ই অদ্ভুতভাবে তিনি মারা গেলেন ২০২০-এর ২৬ নভেম্বর। আমি খোঁজ নিয়েও জানতে পারিনি, তিনি করোনায় মারা গেছেন কিনা। কিন্তু মৃত্যুর আকস্মিকতার কথা তিনি জানিয়ে গেলেন। অতিমারির সময় এই আকস্মিকতা আরও বেশি ভয়ংকর। কারণ, কভিড-১৯ একটি অণুজীব, খালি চোখে দেখা যায় না। কাজেই সেটা কীভাবে মৃত্যু নিয়ে আসছে, মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আগে তা টেরই পায় না।
মানুষের চলে যাওয়ার মিছিলের মধ্যে এসে গেল কোরবানির ঈদ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এই ঈদের সময় বড়সড় আয়োজনে নামে, যেটা রোজার ঈদের সময় করতে হয় না। কারণ, কোরবানি ঈদের ধরনটাই হচ্ছে সমষ্টিগত। গরু কিনতে বাজারে যাওয়া, গরু কিনে এনে বাড়িতে কয়েক দিনের জন্য রাখা, কোরবানির দিন মৌলভি খুঁজে নেওয়া, তার আগে মসজিদ বা ঈদগাহে গিয়ে নামাজ আদায় করা, গরু জবাইয়ের পর কসাইয়ের পাওনা চুকানো, গোশতের বণ্টন ইত্যাকার কাজ মিলিয়ে এবার যে জনসমাগম হবে, তাতে ব্যাপক সংক্রমণ ঘটতে পারে। ভবিষ্যৎ রইল ভবিষ্যতের হাতে।
কোরবানির কারণে বিধিনিষেধ শিথিল এবং এ কারণে অতিমারির সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর বিরাট চাপ পড়বে। খবরে পড়লাম, ময়মনসিংহের শেরপুরের এক সংকটাপন্ন যাত্রীকে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নিয়ে এসে কোথাও আইসিইউ না পেয়ে চট্টগ্রামের দিকে ছুটেছে অ্যাম্বুলেন্সটি। এই রোগীর কী হবে! আবার চট্টগ্রামের অবস্থাই বা কী! পত্রিকায় দেখলাম, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত এক ডাক্তার রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন করোনা আক্রান্ত আরেকজন ডাক্তার। প্রথমজন আইসিইউফেরত, দ্বিতীয়জন শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন।
কাজেই সার্বিক চিত্রটি মোটেও ভালো নয়, কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা তো ঈদ করবেনই। এ বিষয়ে অনলাইনে পশু কেনার যে একটা হিড়িক তৈরি হয়েছিল এবং গত বছর অতিমারির সময় যেটি খানিকটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেটা এ বছর খানিকটা স্তিমিত হয়ে গেছে। তার বিভিন্ন কারণ আছে, গত বছর অনেকে অনলাইনে গরু কিনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তারা এবার সরাসরি কেনার দিকে ঝুঁকেছেন। তার ওপর গত বছর ভয় ছিল বেশি, মানুষ ঘর থেকে বের হয়নি ফলে অনলাইনে রমরমা ব্যবসা হয়েছে। কিন্তু করোনার সঙ্গে দীর্ঘ ১৮ মাসব্যাপী বসবাস করার ফলে মানুষের ভয় খানিকটা উবে গেছে। কিছু লোক ভ্যাকসিন নিয়ে সাহসীও হয়ে উঠেছে। কঠোর থেকে কঠোরতর বিধিনিষেধ আরোপ করেও মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। ভয় কমলেও মৃত্যু বেড়ে গেছে- এই সত্যটা সাধারণ মানুষ মানতেই চাইছে না। ঘরে ঘরে স্ত্রীর বারণ স্বামীর না শোনা, বাবার বারণ ছেলের না শোনা কিংবা ছেলের বারণ বাবার না শোনার একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাবা ছেলেকে বলছে, 'বাপ রে হাটে যাস না।' ছেলে বাবাকে বলছে, 'বাপজান, হাটে যাবেন না।' কিন্তু কে শোনে কার কথা! উপরন্তু কোরবানি দিলে গরু কিংবা ছাগল তো কিনতেই হবে। ঝুঁকি তো নিতেই হবে।
পবিত্র কোরআন শরিফের সুরা হজের ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, কোরবানি করা পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না, পৌঁছায় কোরবানিদাতার তাকওয়া বা আল্লাহর প্রতি ভয়, তারপরও মানুষ ছোটে গরুর আকারের প্রতি। কোরবানিকে তার উৎস আত্মার পবিত্র শুচিতার প্রয়োজনীয়তা থেকে উৎখাত করে মানুষ ছোটে গরুর সৌন্দর্য ও আকারের প্রতি। মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা ঈদুল আজহার মতো এমন ধর্মীয় উৎসব আর নেই। সেজন্য গরুর হাট থেকে বাসায় গরু নিয়ে ঢোকার আগ পর্যন্ত একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়- 'গরুর দাম কত!'
সামাজিক মানুষ ধর্ম পালন করে যতটা না আধ্যাত্মিক কারণে, তার চেয়েও বেশি সামাজিক আচার-উপাচার হিসেবে। কোরবানির নিহিত তাৎপর্য হলো, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে ত্যাগ করার মানসিক প্রস্তুতি। সুরা ছোয়াফফতে আছে, (আয়াত ১০০ থেকে ১০৬) হজরত ইব্রাহিম (আ.) যখন স্বপ্টেম্ন নির্দেশ পেলেন যে, তার প্রিয় সন্তান ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর নামে কোরবানি করতে হবে, তখন পিতা-পুত্র উভয়েই সে আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হলেন, তখন আল্লাহ বললেন, 'হে ইব্রাহিম, তুমি আমার আদেশ পালন করেছ।' তখন ইসমাইলের পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হলো। কোরআনের অনুবাদক আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী বলছেন, এই পুরো ব্যাপারটাই হলো প্রতীকী, যার মধ্য দিয়ে আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর তাকওয়াকে বাজিয়ে দেখলেন।
এই যে পুত্র ইসমাইলের বদলে দুম্বা কোরবানি হলো, অর্থাৎ পিতা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে নির্দি্বধায় পুত্রের জীবন উৎসর্গ করতে রাজি হলেন বা পুত্রও রাজি হলেন; সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এটি একটি অতি প্রাচীন উপচার; যা আদিম মানবগোষ্ঠী থেকে, প্যাগান বা গ্রিক ও রোমান সভ্যতা হয়ে প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলোতে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ চিত্তের শুদ্ধতা অর্জনের জন্য পশু কোরবানি দেওয়া মানবসমাজের বহু পুরোনো আচার। সেজন্য আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী রেনে জিরার্ড প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য থেকে উপমা টেনে সংকটটি ব্যাখ্যা করেছেন। ইউরিপিডিসের নাটক 'হেরাক্লিস'-এ আছে হেরাক্লিস তার অভিযানগুলো শেষ করে দেশে ফিরেছে। ফিরে দেখে তার স্ত্রী-পুত্র লাইকাস নামের একজন শাসকের অধীনে বন্দি হয়ে আছে। সেই শাসক তাদের বলিদানের জন্য তৈরি করছিল। হেরাক্লিস শহরের কেন্দ্রস্থলে গিয়ে লাইকাসকে হত্যা করে তার স্ত্রী-পুত্রকে উদ্ধার করে। এ হত্যাকাণ্ডের ফলে তার প্রয়োজন পড়ে বলিদানের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। তার স্ত্রী-পুত্র তার সঙ্গে থাকে। এ সময় হঠাৎ সে উন্মাদ হয়ে যায় এবং ভ্রমবশত নিজের স্ত্রী-পুত্রকে শত্রুপক্ষ মনে করে বলি দিয়ে দেয়। এই উদাহরণের মোজেজা হলো, বিসর্জন বা উৎসর্গ আর হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ব্যবধান খুবই সূক্ষ্ণ। জিরার্ডের মতে সংকটটা এখানেই যে, যখন হেরাক্লিস পবিত্র বলিদানের আয়োজন করছিল, তখনই সে আসলে হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়।
আমরাও যদি কোরবানির উৎসর্গের সময় এর আধ্যাত্মিক দিকটি, অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ঠিকমতো স্থাপন না করি, তাহলে কোরবানিতে আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ আর হাটে কসাইয়ের পশু জবাইয়ের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকবে না।
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
- বিষয় :
- পবিত্র ঈদুল আজহা
- মোহীত উল আলম