ঢাকা বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ 

ভাবিয়া করিও কর্ম

ভাবিয়া করিও কর্ম

কোলাজ

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ১১:৫৬

অন্তর্বর্তী সরকার গত নভেম্বরে যখন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে প্রণীত বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করিয়াছিল, উহাকে স্বাগত জানাইয়াও অত্র সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা সতর্ক করিয়াছিলাম– ভবিষ্যতে অনুরূপ নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়ন না করিবার ব্যাপারেও অঙ্গীকার জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ লইয়াও অনুরূপ আশঙ্কার উদ্ভব হইয়াছে। 

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৪ এর খসড়ায় অনুমোদন দেওয়া হয়। আমরা দেখিয়াছি, এই প্রকার আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার কীভাবে সংবাদিকসহ নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের পথ সংকুচিত করিয়াছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে যদিও উহার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা ফুৎকারে উৎক্ষেপ করা হইতেছে; উহাতে আশ্বস্ত হইব কতখানি? আমাদের প্রশ্ন, পূর্বেকার আইনটি বাতিল হইবার পর সকলে যেই স্বস্তি অনুভব করিয়াছিল, প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ লইয়া উহা অস্বস্তিতে রূপান্তরিত হইল কেন?

স্বীকার্য, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ায় বিতর্কিত আটটি ধারা বাদ দেওয়া হইয়াছে। এই সকল ধারা অধিকতর নিবর্তনমূলক ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য। দেখা গিয়াছে, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরাই এই সকল ধারার মামলায় বেশি ভুক্তভোগী। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেটপ্রাপ্তির অধিকার স্বীকার করা হইয়াছে, যাহা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এই অধ্যাদেশে যেইভাবে সাইবার স্পেসে জুয়া খেলাকে অপরাধ ও দণ্ডনীয়রূপে উপস্থাপন করিয়াছে, উহাও প্রয়োজনীয় বটে। কিন্তু ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট অংশীজন আশঙ্কা করিয়াছেন, কিছু ধারার কারণে ডিজিটাল আইনের মতোই অপব্যবহারের ঝুঁকি রহিয়া যাইতেছে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে। ইহাতে বুলিং, ধর্মীয় উস্কানি, ওয়ারেন্ট ব্যতীত পুলিশের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা-সংক্রান্ত ধারাগুলির মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পুনরায় কুক্ষিগতকরণের উপলক্ষ তৈয়ার হইয়াছে।

প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে যেইভাবে সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক ও পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে, উহা বিগত সরকারের সাইবার নিরাপত্তা আইনের সহিত বহুলাংশে মিলিয়া যায়। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে দুর্বোধ্য যেই সকল শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নাই, উহার মাধ্যমে অধ্যাদেশটি অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈয়ার হইবে। বলিবার অপেক্ষা রাখে না, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ৮, ২৫, ২৬, ৩৫ ধারা পূর্বের অনুরূপ নিবর্তনমূলক হইয়া উঠিবার সমূহ শঙ্কা বিদ্যমান। বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে যেইভাবে বিবৃত, উহা নিয়ন্ত্রণমূলক ও নজরদারি অধ্যাদেশে পরিণত হইবার অভিযোগ উঠিয়াছে। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের যেই সকল উদ্বেগের বিষয় উঠিয়া আসিয়াছে, উহা অমূলক নহে। তাহারা ইহাকে যেইভাবে সাইবার নিরাপত্তা আইনের পুনরাবৃত্তি বলিয়া আশঙ্কা করিয়াছে, উহা বেদনাদায়ক বাস্তবতা। যেই কারণে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার পুরাতন আইনটি বাতিল করিয়াছে, সেই সকল নিপীড়নমূলক বিধির একটিও যদি নূতন অধ্যাদেশে বিদ্যমান থাকে, উহাও গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। একদিকে সরকার বলিতেছে, এই অধ্যাদেশ দ্বারা সাইবার স্পেস ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হইবে, অন্যদিকে অংশীজন 

যদি ভিন্ন বাস্তবতা তুলিয়া ধরে, উহার অর্থ হইল অধ্যাদেশটি চূড়ান্তকরণের পূর্বে আরও আলোচনার অবকাশ রহিয়াছে। সেই কারণে সকল অংশীজনকে আস্থায় আনিতে পারে, এ অধ্যাদেশকে সেইভাবে সংশোধন ও পরিমার্জন করিতে হইবে। আমরা মনে করি, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নাগরিকবান্ধব হওয়া জরুরি। উহা যেহেতু এখনও খসড়া আকারে রহিয়াছে, সেহেতু বিতর্কিত ধারাগুলি বাদ দিয়া চূড়ান্তকরণই সংগত হইবে। এই ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তরিক হইবে বলিয়া আমাদের প্রত্যাশা। 

আরও পড়ুন

×