তথ্যপ্রযুক্তি
সাইবার জগতে আমরা কতটা নিরাপদ
অজিত কুমার সরকার
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০
ওয়েস্টফালিয়ান সার্বভৌমত্ব বা প্রত্যিটি জাতিরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক আইনস্বীকৃত সার্বভৌম সীমানা রয়েছে। ইন্টারনেট সনাতনী ওয়েস্টফালিয়ান সার্বভৌমত্ব বা রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে নতুন এক বিশ্বের উদ্ভব ঘটিয়েছে, যার নাম সাইবার বিশ্ব (জগৎ)। এর ফলে প্রতিটি রাষ্ট্র হয়েছে বিশ্বগ্রামের অন্তর্ভুক্ত। ইন্টারনেটভিত্তিক এই বিশ্বগ্রামের কোনো সীমানা বা অঞ্চল নেই। কানাডিয়ান দার্শনিক মার্শাল ম্যাকলুহান বিশ্বগ্রামের ধারণা দিয়েছেন এভাবে- যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন পরস্পর সহজে যোগাযোগ, কথোপকথন, গণমাধ্যম ও ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুক্ত থাকে এবং ক্রমেই একটি একক কমিউনিটিতে পরিণত হয়। সাইবার জগৎ বা অনলাইন জগৎ বা বিশ্বগ্রাম যা-ই বলি না কেন; মানুষের সমাজ এবং শিল্প ক্রমেই সাইবার জগতের ওপর বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে সাইবার জগৎ ভৌত জগতের একটি কেন্দ্রীয় এবং অন্তর্নিহিত উপাদান হয়ে উঠেছে। চিন্তাবিদ ইউভাল নোয়া হারারির ভাষায়, এই অনলাইন জগৎ যেন এক অদৃশ্য স্বয়ম্ভূ শক্তি হয়ে মানুষকে চালাচ্ছে। তথ্য, ধারণা ও ব্যবসার জন্য মানুষ দ্বারস্থ হচ্ছে অনলাইন শক্তির কাছে।
প্রশ্ন হলো, সাইবার জগতে আমরা কতটা নিরাপদ? বিশেষ করে হ্যাকিং, অর্থ ও ডাটা চুরি, প্রপাগান্ডা, সাইবার বুলিংয়ের মতো ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগামী দেশগুলোর জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে উদ্বেগের মাত্রাটা আরও বেড়ে যায় তখন, যখন আমরা দেখি হ্যাকিং ও ডাটা চুরিতে রাষ্ট্রগুলো যুক্ত হচ্ছে। কোনো কোনো রাষ্ট্র সাইবার জগতে এক ধরনের 'অদৃশ্য' যুদ্ধে লিপ্ত। যাকে বলা হচ্ছে, সাইবার জগৎ বা পঞ্চম ডোমেইনের (ক্ষেত্র) যুদ্ধ। বলা হচ্ছে, মানুষ এতদিন জল, স্থল, আকাশ, মহাকাশ- এই চার ক্ষেত্রে যুদ্ধ দেখে আসছে। আর এখন দেখছে সাইবার জগতের যুদ্ধ। এ জগতের যুদ্ধে রাষ্ট্রগুলোর যুক্ততা নিয়ে বিশ্বখ্যাত দ্য ইকোনমিস্টের ২০১০ সালের ১ জুলাই সংখ্যায় 'ওয়ার ইন ফিফথ ডোমেইন' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। মূলত এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে মানুষ প্রথম জানল সাইবার জগতে দেশগুলো যুদ্ধে লিপ্ত। প্রতিবেদনে বলা হয়, সোভিয়েত গুপ্তচররা কানাডার একটি ফার্ম থেকে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম চুরি করেছিল। কিন্তু সিআইএ সিস্টেমটি একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে আগেই ম্যানিপুলেট করে রেখেছিল। সে কারণে সাইবেরিয়ার গ্যাস পাইপলাইনে এটি ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে বিস্ম্ফোরণ ঘটে। এটি ছিল একটি বড় ধরনের নন-নিউক্লিয়ার বিস্টেম্ফারণ। আকাশ থেকেও আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখা যায়। ঘটনাটির কথা ২০১০ সালে প্রকাশ পেলেও সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন প্রায়ই একে অপরের বিরুদ্ধে গোপনীয় ডাটা চুরির অভিযোগ আনছে।
বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সাইবার যুদ্ধ প্রকট রূপ ধারণ করেছে।
বিশ্নেষণে দেখা যায়, ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও গোষ্ঠী নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই সাইবার জগতে অপরাধ সংঘটিত করছে। কেউ রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য, অর্থ ও প্রতিষ্ঠানের ডাটা চুরি করছে; কেউ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, কেউ নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। আবার কেউ রাজনৈতিক স্বার্থে কম্পিউটেশনাল প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হ্যাকারদের লক্ষ্য থাকে অর্থ ও ডাটা চুরি। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়াও অনেক হ্যাকারের লক্ষ্য। ২০১০ সালে সাংবাদিক ও কম্পিউটার হ্যাকার বলে পরিচিত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ 'উইকিলিকস' ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গোপন মার্কিন দলিল ফাঁস করে বিশ্ব কাঁপিয়ে দেন। র্যানসামওয়্যার ভাইরাস পাঠিয়ে কম্পিউটারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অর্থ দাবি করা হচ্ছে। এর নেপথ্যেও রয়েছে হ্যাকাররা। সাইবার জগতে অপরাধের কারণে ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। মেধাস্বত্ব ও ব্যবসায়িক তথ্য চুরি, সাইবার অপরাধ, সেবা প্রদানে বাধা, হ্যাকিং ইত্যাদি কারণে বিশ্বে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। (ম্যাকাফি ও সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষণা, জুলাই ২০১৩)।
কিন্তু আমাদের সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গাটা কোথায়, তা নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথমত, হ্যাকাররা দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেট হাউসগুলো তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে কোনো মুহূর্তে হ্যাকারদের আক্রমণের শিকার হতে পারে বলে সংশ্নিষ্ট সবাইকে সতর্ক করেছেন। তাঁর এই আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয়, এর প্রমাণ বেক্সিমকোসহ কয়েকটি করপোরেট হাউস হ্যাকারদের আক্রমণের শিকার হওয়া।
দ্বিতীয়ত, প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। যাকে বলা হচ্ছে কম্পিউটেশনাল প্রপাগান্ডা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচারের নানা উপাদানে ঠাসা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী এবং ক্ষমতাসীনদের টার্গেট করেই অপপ্রচার ও কুৎসা রটানো হচ্ছে বেশি। ইউটিউব ও ফেসবুকে অপপ্রচারের ভিডিওগুলোর অধিকাংশই বিদেশ থেকে অথবা ভুয়া আইডি ব্যবহার করে আপলোড করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো ক্ষতিকর পোস্ট সমাজে অস্থিরতা তৈরি করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রামুর বৌদ্ধ মন্দির, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং কুমিল্লার পূজামণ্ডপে হামলার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়ে মানুষের মধ্যে সেন্টিমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল। ছেলে ধরার গুজব ছড়িয়ে রেনুকে হত্যা, নারীর ছবি ম্যানিপুলেট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে।
সাইবার জগতে আলোচ্য উদ্বেগজনক ঘটনাগুলোর প্রতিকার নিয়েই যত দুশ্চিন্তা। ২০১৬ সালে হ্যাকাররা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করার পর অনলাইন কার্যক্রমকে নিরাপদ রাখতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ব্যবহারকারীকে অনলাইনে নিরাপত্তা প্রদান করা, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তথা 'কেপিআই'-এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সেবা প্রদান নিরাপদ করা, তথ্য ও ডাটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গুণগত মানের সফটওয়্যার ব্যবহার। গড়ে তোলা হয়েছে সাইবার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম-সার্ট। এসব উদ্যোগের সুফল মিলছে। সার্টের দক্ষতার কারণেই ২০২১ সালের জুনে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) সাইবার নিরাপত্তা সূচক-২০২০ এ বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩তম। এর আগে ছিল ৭৮। অর্থাৎ বৈশ্বিক সাইবার নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশ ২৫ ধাপ এগিয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও দেশব্যাপী সাইবার সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আইসিটি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের 'এনহান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি' প্রকল্প।
অজিত কুমার সরকার : সিনিয়র সাংবাদিক
ajitsarkar91@gmail.com