সমকালীন প্রসঙ্গ
সুইডেনের 'করোনামুক্তি' থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা

রহমান মৃধা
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৫:২০
বিশ্বে সুইডেন একমাত্র দেশ; করোনা প্যান্ডেমিক নিয়ন্ত্রণে 'লকডাউন' বাস্তবায়ন করেনি। তবে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং অসুস্থ হলে বাসায় থাকতে জনগণকে অনুরোধ করেছে শুরু থেকেই। কিন্ডারগার্টেন ও স্কুল খোলা রেখেছে এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে বাসা থেকে কাজ ও প্রশিক্ষণ চালু রেখেছে। সুইডেনের জনস্বাস্থ্য সংস্থা গত বুধবার ঘোষণা দিয়েছে, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন। করোনা দেশের জন্য এখন থেকে কোনো জটিল রোগই নয়। ফলে এ-সংক্রান্ত সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলো। এখন কভিড পাস লাগছে না। বাধ্যতামূলক দূরত্ব বজায় রাখা বাতিল করা হয়েছে। বাস, ট্রেন বা রেস্টুরেন্টে দূরত্ব বজায় রেখে বসার সাইনবোর্ড তুলে নেওয়া হয়েছে। মিছিল-সমাবেশেও কোনো বাধা নেই।
এটা ঠিক, গত দুই মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছে বহু মানুষ। এক কোটি জনসংখ্যার দেশ সুইডেন সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহ ধরে দৈনিক ৫০ হাজারের বেশি মানুষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালে ভর্তির হার ছিল অত্যন্ত কম।
বিশ্বের সবচেয়ে সফল টিকাকরণ দেশের মধ্যে সুইডেন একটি। এর ৭০ শতাংশের বেশি নাগরিক টিকার আওতায় এসেছে। সুইডিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্তের সংখ্যা অনেক হলেও হাসপাতালে ভর্তির পরিস্থিতিতে পড়ছেন হাতেগোনা কিছু মানুষ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, 'হার্ড ইমিউনিটি' সুইডিশদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। ফলে করোনা আগের মতো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমতাবস্থায় বিধিনিষেধ আরোপ করে জনজীবনকে ব্যতিব্যস্ত করার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। আগামী দিনে করোনার নতুন কোনো রূপ আবির্ভূত হবে কিনা, জানা নেই। কিন্তু সুইডেন থেকে করোনা বিধিনিষেধ আপাতত বিদায়।
গত সপ্তাহে ডেনমার্কও করোনা-সংক্রান্ত সব বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে। স্পেন ও ইংল্যান্ড একই পথে হাঁটতে শুরু করেছে। সেখানে মাস্ক পরা আর বাধ্যতামূলক নয়। আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসেও লকডাউন শিথিল করার প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছে। দৈনিক বিপুল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ফ্রান্সে। তবুও সে দেশে বিধিনিষেধ শিথিল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সুইডিশ কর্তৃপক্ষ মনে করছে, বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার মূল শক্তি করোনা টিকাকরণের হার। গত দুই বছরে কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ১২ বছরের বেশি বয়সী প্রত্যেককে টিকা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা বাকি আছেন, তাদেরও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকা নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতিও সুইডেনের মতো; তবে অঘোষিতভাবে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও খোলা রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব আবাসিক হল। ওমিক্রনের মধ্যেই খোলা আবাসিক হলে অবস্থান করছেন বহু শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাস বন্ধ হলেও শিক্ষাঙ্গনের আশপাশে গড়ে ওঠা ব্যক্তিমালিকানাধীন ছাত্রাবাসে অবস্থান করছেন হাজারো শিক্ষার্থী। তারা একসঙ্গে এসব আবাসিক ছাত্রাবাসে বসবাস করছেন। একই ডাইনিংয়ে দল বেঁধে খাওয়া-দাওয়া করছেন। দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করছেন। একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। আমার ধারণা, অন্তত শিক্ষাক্ষেত্রে ইতোমধ্যে 'হার্ড ইমিউনিটি' হয়ে গেছে।
আমি মনে করি, এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার যুক্তি নেই। এসব ক্ষেত্রে ওমিক্রন কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে ওমিক্রনের প্রকোপ বেড়ে যাবে- এ অজুহাতে শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, যারা মনে করেছিলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলেই শিক্ষার্থীরা বাসায় অবস্থান করবে- তাদের সে আশা মোটেই পূরণ হয়নি। শিক্ষার্থীরা শপিং, সিনেমা হলে যাচ্ছে; টি-স্টলে আড্ডা দিচ্ছে। সুযোগমতো মা-বাবার সঙ্গে পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরতে যাচ্ছে। কোনো কিছুই থেমে নেই। তাহলে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম থেমে থাকবে কেন?
শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া উচিত। অবশ্য 'খোলা' তো আছেই। কিছু কি বন্ধ আছে? হাট-বাজার, শহর-বন্দরে মানুষের ভিড় সমান। বেশিরভাগের মুখে আবার মাস্ক দেখা যায় না। পত্রপত্রিকায় যা দেখছি, বাংলাদেশে গত দুই মাসে ওমিক্রনে আক্রান্তের হার ব্যাপকভাবে বাড়লেও হাসপাতালে ভিড় বাড়েনি। আক্রান্তরা ঘরের মধ্যে নিভৃতবাসের মাধ্যমে সামান্য চিকিৎসা নিয়েই সেরে উঠছেন। এটাও অনুমান করা যায়, ওমিক্রনের 'সামান্য' উপসর্গ অধিকাংশ নাগরিক আমলে নেননি। সামান্য ঠান্ডা-কাশি নিয়েই কর্মস্থলে গেছেন। বিশেষভাবে খেটে খাওয়া মানুষের এসব নিয়ে ভাবার সময় ছিল না। যাদের দিন এনে দিন খেতে হয়, তাদের পক্ষে জ্বর, ঠান্ডা-কাশি নিয়ে ঘরে বসে থাকার 'বিলাসিতা' কি মানায়?
এটা ঠিক, টিকাদানের হারে সুইডেনের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সূত্রমতে দুই ডোজ টিকা গ্রহণকারী নাগরিকের হার জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের নিচে। এখন জোর দিতে হবে অন্তত ৭০ শতাংশ নাগরিক যাতে দুই ডোজ টিকা পায়। তাহলে এখন যে অনানুষ্ঠানিকভাবে সবকিছু খোলা রাখা হচ্ছে; তখন তা আনুষ্ঠানিকভাবেই খোলা রাখা যাবে। শিক্ষার্থীরাও ফিরে যেতে পারবে ক্লাসরুমে।
সবকিছু খুলে গেলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সুইডেনে ইতোমধ্যে গত দুই বছর বাড়ি বসে কাজ করার সুযোগ অনেকে মিস করছে। আবার একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতে অফিস বা ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরে যাওয়া অনেকের কাছে বেশ এক্সাইটেড মনে হচ্ছে। এখন এখানে ম্যানেজমেন্ট স্টাইল চেঞ্জ করার কথা উঠছে। তাদেরও অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে; ফ্লেক্সিবল হতে হবে। কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে 'হাইব্রিড'। যেখানে কর্মীরা তাদের প্রয়োজনমতো কাজ অফিসে এসে বা বাসায় বসে করতে পারবে।
রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com
- বিষয় :
- সমকালীন প্রসঙ্গ
- রহমান মৃধা