‘বাবা নেই ১৯ বছর, পুরো বিষয়টিই আমার জন্য বিস্ময়কর’

সুবর্ণা মুস্তাফা
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ০৫:১৩ | আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ০৫:১৯
আজ অভিনেতা, আবৃত্তিশিল্পী গোলাম মুস্তাফার ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৩ সালের এই দিনে মারা যান তিনি। তার জন্ম হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ২ মার্চ। কীর্তিমান এই শিল্পীকে নিয়ে তার মেয়ে ও অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার স্মৃতিচারণ
দেখতে দেখতে ১৯ বছর হয়ে গেল! ১৯ বছর অনেক লম্বা একটা সময়। কিন্তু আমার কাছে এখনও মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। ১৯ বছর হলো বুবা [বাবা] নেই, পুরো বিষয়টিই আমার জন্য বিস্ময়কর। তিনি আমার অনুভূতিতে মিশে আছেন সবসময়।
বুবার কাজ আর ব্যক্তিজীবনের গল্পের শেষ নেই। তাকে কেন্দ্র করে ঘটনাগুলো শোনার পর মনে হবে, আরও কত গল্প যে শোনা বাকি রয়ে গেল! তিনি একজন মুক্ত চেতনার মানুষ ছিলেন। আমি নিজেও তার মতো করে মুক্ত চিন্তার চেষ্টা করি। শুধু আমি নই বুবার সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, তারাও মুক্তচিন্তার পথেই হেঁটেছেন সবসময়। গোলাম মুস্তাফা সময়কে উত্তীর্ণ করার মতো একজন মানুষ ছিলেন।
বুবার কাছে থেকে আমি আর আমার ভাই সুমিত পেয়েছি দেশপ্রেম, দেশের প্রতি ভালোবাসা। তিনি বলতেন, 'আমাদের সমাজে যত ধরনের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস, তাবিজ-কবজ, জাদু-টোনা, বান থেকে শুরু করে সব অবৈজ্ঞানিক ঘটনা সমাজকে এগোতে দেয় না।'
আমার একটা কথা খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে পাথরের আংটির ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন_ 'জন্ম নিয়েছি, লেখাপড়া শিখেছি, হাত-পা, বুদ্ধিবৃত্তি আছে। নিজের কর্মক্ষমতা দিয়ে যদি নিজের ভাগ্য নিজে বদলাতে না পারি, তাহলে ধরে নিতে হবে আমাকে সবসময় দুর্ভাগা হিসেবেই থাকতে হবে। এক ইঞ্চির চেয়েও ছোট পাথরের একটা আংটি ভাগ্য বদলে দেবে? এর কোনো প্রয়োজন নেই।'
বুবার এই কথা বলার কারণ এজন্য যে, এখন বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে পুরো পৃথিবীতে কত কি আবিষ্কার হচ্ছে। এরপরও মানুষ পাথর, ঝাড়ফুঁকে অন্ধ বিশ্বাস করছে_ এটা ঠিক নয়। একটি পাথর কখনও মানুষের ভাগ্য বদলাতে পারে না। মানুষ তার কর্ম দিয়েই ভাগ্য বদলাতে পারে।
কোনো একটি ঘটনা নিয়ে একদিন বুবা কথা বলছিলেন, 'দেখ সুবর্ণা মানুষের মন খুব অদ্ভুত। যে কোনো সময় যে কোনো কিছুই মনে হতে পারে। তা ভালো হতে পারে আবার কিছুটা খারাপও হতে পারে। মনের চাওয়ার ওপর কারও কোনো হাত নেই। কিন্তু সেই চাওয়াটাকে সে কীভাবে মূল্যায়ন করবে সেটাই বড় বিষয়।' তিনি প্রায়ই বলতেন, 'একজন মানুষ কোথায় জন্মগ্রহণ করবে, সেটা তার হাতে নেই। কিন্তু জন্মের পর সে কীভাবে জীবনযাপন করছে তা-ই মূল বিষয়। কে ভালো মুসলিম বা ভালো হিন্দু হবেন_ সেটা নির্ভর করে তার কর্মের ওপর।'
বুবা কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। সত্যি কথা বলতে কখনও ভয় পেতেন না। এ বিষয়ে একটা ঘটনার কথা বলি। তখন আমরা অনেক ছোট। আমার বড় চাচা পাকিস্তান আমলে ইপিআইডিসির চেয়ারম্যান ছিলেন। অনেক চেস্টা করে কোনো একটি কাজে তার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাচার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। পরে তিনি বুবার কাছে চাচার সঙ্গে দেখা করার সুপারিশ নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ভদ্রলোক যে ভুলটি করলেন তাহলো তিনি বুবাকে একটি ব্রিফকেসভর্তি টাকার লোভ দেখালেন। বাড়ির ভেতর থেকে আমরা দেখলাম, বুবা বেশ রেগে গেছেন। শুধু গায়ে হাত তুললেন না, এ ছাড়া ভদ্রলোককে অনেক বকাঝকা করে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তাকে কখনও প্রলোভনের দিকে যেতে কিংবা লোভে পড়তে দেখিনি। বুবা খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। আমি একটি কথা বারবার বলি যে, সাধারণ জীবনযাপন করা খুব কঠিন। তিনি চিরতরে চলে যাওয়ার পর অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন 'মুস্তাফা ভাইয়ের এসিটা [শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র] কী করলেন? কিন্তু যখন তারা শুনেছিলেন যে, আমাদের বাসায় কোনো এয়ারকন্ডিশনার ছিল না, তখন তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। এসি থাকা কোনো বিষয়ই ছিল না আমার বুবার জন্য। কিন্তু আমার মা ঠাণ্ডা পছন্দ করতেন না। তবে আমার মতো বুবার ঠাণ্ডায় কোনো সমস্যা হতো না।
বুবা আর মায়ের গল্পটা ভালোবাসার। একদিন বুবাকে বলেছিলাম, 'গরমে তোমার কষ্ট হয়, পাশের বেডরুমে এসি লাগিয়ে নাও।' একথা শুনে বুবা আমার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে বললেন, 'একটা এসির জন্য তোমার মা এখানে ঘুমাবেন আর আমি পাশের ঘরে ঘুমাব। হাউ স্ট্রেঞ্জ সুবর্ণা?' সেদিন সেই কথাটা বলার পর আমার নিজেকে খুবই বোকা মনে হয়েছিল।
মা খুবই অসুস্থ ছিলেন। তখন অনেক চ্যানেলেই নাচ-গানের পাশাপশি নানান অনুষ্ঠান হতো। কিন্তু মা সবসময় বিটিভিই দেখতেন। বিটিভিতে তেমন কিছুই হতো না। মা টিভি দেখছেন, আর বুবা বসে বই পড়ছেন। আমি একটি অনুষ্ঠান দেখে এসে বুবাকে বলেছিলাম, তুমি বিটিভি না দেখে অন্য চ্যানেল দেখতে পারো। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন, মুখে কিছু বললেন না।আমিও চুপ হয়ে গেলাম। মা ঠিক রাত ১০টায় ঘুমাতে যেতেন। মাকে শুইয়ে দিয়ে এসে তিনি বললেন, 'শোনো তোমার মায়ের শরীর ভালো না। আর উনি অন্য কোনো চ্যানেল দেখতে পছন্দ করেন না। আমি এ সময়টা উনার সঙ্গে থাকি। দেখুক না। ও যখন দশটায় শুয়ে পড়বেন তখন অন্য চ্যানেল দেখব।'
বাবা-মায়ের ভালোবাসাটা অদ্ভুত ছিল। আমরা সবাই জানি, বাবা-মায়ের কাছে সন্তানেরা আগে। কিন্তু অবশ্যই আমার বুবার কাছে মা ছিলেন সবার আগে। বুবার কাছে থেকে শিখেছি দায়িত্ব পালন সম্পর্কে। যত কষ্টই হোক না কেন, বুবা কখনও দায়িত্বের জায়গা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। তার কাছ থেকে আরও শিখেছি মানুষকে সম্মান করা।
তখন আমার বয়স ৭ বা ৮ বছর হবে। বুবার সঙ্গে রিকশায় বাড়ি ফিরছি। তার হাতে একটি প্যাকেট ছিল। তিনি আমার হাতে টাকা দিয়ে বললেন, রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে। আমি টাকাটা নিয়ে গিয়ে রিকশাওয়ালাকে বলেছি_ 'এই যে টাকা নাও!' ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ওই ধরনের ভুল। বুবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এদিকে এসো, কী বললে তুমি? তুমি কি ওনাকে তুমি বলে সম্বোধন করলে?' তখনই বুঝেছি সর্বনাশ হয়ে গেছে। 'হ্যাঁ'। 'কেন তোমার কি ওনাকে দেখে মনে হয়েছে তোমার চেয়ে বয়সে উনি ছোট?' আমার কথা শুনে বললেন, 'যথেষ্ট বয়স হয়েছে ওনার, কেন তুমি করে বললে? রিকশা চালাচ্ছে এজন্য? তুমি রিকশা চালাতে পারবে? আমি রিকশা চালাতে পারব?' এদিকে তখন রিকশাওয়ালা বলেই চলেছেন, 'থাক থাক স্যার কিছু হবে না।' বুবা আমাকে বললেন, 'যাও ওনার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে এসো।'
এদিকে তখন আমার কান লাল হয়ে যাচ্ছে। পরে আমাকে গিয়ে রিকশাওয়ালার কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। সেই থেকে আমি রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে অপরিচিত কারও সঙ্গে আপনি ছাড়া কথা বলি না। গোলাম মুস্তাফা কত বড় অভিনয়শিল্পী বা আবৃত্তিকার সেটা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্ম সেগুলো কি শুধু মুখে মুখেই শুনে যাবে। আমাদের এখানে অনেক সংগ্রহশালা আছে। নতুন প্রজন্মের জন্য শুধু বুবাই নন, বাংলাদেশের আরও যারা দিকপাল অভিনয়শিল্পী বা যাদের কাজ মানুষকে প্রভাবিত করেছে, তাদের কাজগুলো সংরক্ষণ করে রাখা প্রয়োজন।