ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

সাক্ষাৎকার: এস এম মান্নান কচি

রপ্তানিতে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হোক

রপ্তানিতে প্রণোদনা  অব্যাহত রাখা হোক

এস এম মান্নান কচি

 আবু হেনা মুহিব

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৪ | ০০:৩৮ | আপডেট: ২৮ মে ২০২৪ | ১৫:৩৩

তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেছেন, পোশাক খাতে সাফল্য যেমন আছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও আছে অনেক। গত এক দশকে চালু কারখানার সংখ্যা ৫ হাজার থেকে ২ হাজার ২শতে নেমে এসেছে। সম্প্রতি ন্যূনতম মজুরি ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। গত ৫ বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫০ শতাংশ। কিন্তু রপ্তানি পণ্যের দাম বাড়ছে না। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে রপ্তানিতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণের জন্য তারা সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি, অন্তত ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ পর্যন্ত রপ্তানিতে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হোক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিজিএমইএ সভাপতি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, আগামী বাজেটের জন্য তারা আরও কিছু সুপারিশ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে নগদ সহায়তার ওপর আয়কর ১০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, বিভিন্ন পণ্য ও সেবা ভ্যাটমুক্ত রাখা, পোশাক খাতের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান জটিলতা জরুরি ভিত্তিতে মোকাবিলা করা; বিশেষত কাস্টমস, বন্ড ও শুল্কায়ন বিশেষ করে এইচ এস কোড ও ওভেন কাপড়ের ওজনসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা। নতুন পণ্য ও নন-কটন টেক্সটাইলে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বিশেষ নীতি সহায়তার দাবি করছেন তারা। এ ছাড়া অগ্নি ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম আমদানির ওপর কর রেয়াত এবং শ্রমিকদের জন্য ফুড রেশনিং বাবদ বিশেষ বরাদ্দ রাখার দাবি রয়েছে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার জন্য এক্সিট পলিসি প্রণয়ন এবং এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধা প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, সম্প্রতি শিল্পাঞ্চলের বাইরে গ্যাস বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ দেওয়া হচ্ছে। এটি বিনিয়োগ ও রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করবে। অনেক কারখানা শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ফেলেছে। এখন বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ না দিলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং  অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে তারা সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন। 
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, গত ৮ মাসে পোশাকের দর পতন হয়েছে ৬ থেকে ১৮ শতাংশ। অপরদিকে কমপ্লায়েন্স ও পরিবেশগত মান উন্নত করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা বাড়ছে। এ কারণে খরচও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এসব শর্ত পূরণ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো টিকে থাকতে পারছে না। নতুন উদ্যোক্তা তৈরির পথ সংকুচিত হয়ে আসছে।

বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি শুরু হয়েছিল কটন শার্ট ও টি-শার্টের মধ্য দিয়ে, যার চাহিদা এখনও বিশ্ববাজারে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। তবে বিশ্ববাজারে কটনের চাইতে নন-কটনের ভাগটিই বেশি। নন-কটন খাতে আমাদের বিনিয়োগ ও বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব ফ্যাশন বাজার এখন নন-কটনের দিকে ঝুঁকছে। ভোক্তাদের ক্রমাগত জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ফলে টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য ও পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে নন-কটন পণ্য তৈরি শুরু করেছেন, এ খাতে এরই মধ্যে বেশ কিছু ভালো বিনিয়োগ এসেছে। তবে নন-কটনে বিনিয়োগ ব্যয়সাপেক্ষ হওয়া এবং এখানে প্রযুক্তি ও গ্যাসের চাহিদা বেশি হওয়ায় বিনিয়োগের পথ মসৃণ নয়। কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৃহদাকারে উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা। নন-কটনের এই ‘ইনিশিয়াল স্টেজে’ বিনিয়োগে উৎসাহ জোগানের জন্য সহায়ক নীতি কাঠামো প্রয়োজন। পাশাপাশি সব ধরনের নন-কটন ফাইবার আমদানির ওপর শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। টেকনোলজি ও নলেজ ট্রান্সফারের ওপরও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে।

পণ্যের বহুমুখীকরণ নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে ব্যাপক বিনিয়োগ করার ফলে ওভার-ক্যাপাসিটি  শিল্পের জন্য অন্যতম দুর্বল পয়েন্ট। তবে এমএফএ কোটা বিলুপ্তির পর রপ্তানিকারকরা কিন্তু ভলিউম-নির্ভর বিজনেস মডেলকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পণ্য বহুমুখীকরণ হয়নি। শিল্পকে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই করতে হলে পণ্য বহুমুখীকরণ ও মূল্য সংযোজন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তারা বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ ও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যেমন– এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যথেষ্ট জ্ঞান ও আন্তরিকতার অভাবে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। নতুন পণ্য তৈরির জন্য নতুন নতুন কাঁচামাল প্রয়োজন হয়। আবার শিল্পের প্রয়োজনে অনেক মেশিন ও ইকুইপমেন্ট আমদানি করতে হয়। এগুলো আমদানি করতে গেলে এইচ এস কোড জটিলতার নামে হয়রানি করা হয়। এসব জটিলতা কমানো গেলে এবং বন্ড, কাস্টমস, ভ্যাট ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে সেবা প্রাপ্তি সহজলভ্য করা গেলে পণ্য বহুমুখীকরণে সফলতা পাওয়া যাবে। একইভাবে নতুন পণ্যে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য সহায়ক নীতি কৌশল ও বিশেষ অর্থায়ন স্কিম নিলে সুফল বয়ে আনবে।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে তারা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন না। বরং অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে প্রতিযোগী সক্ষমতা বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারিগরি প্রশিক্ষণে গুণগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সম্ভাবনাময় পণ্য তৈরি ও নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা উন্নয়ন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একটি রোডম্যাপ প্রয়োজন। এ জন্য আধুনিকায়নের দিক থেকে আমাদের শিল্প পিছিয়ে নেই। আমাদের নতুন নতুন বৃহৎ কারখানাগুলোতে ব্যবহার হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি। আমাদের শিল্পে রয়েছে ২১৭টি সবুজ কারখানা এবং আরও ৫০০টি পাইপ লাইনে আছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ স্কোরের ১০টি সবুজ কারখানার মধ্যে ৯টিই বাংলাদেশে অবস্থিত। এসব কারখানার আধুনিকায়ন ও অটোমেশন অনুকরণযোগ্য। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলোর আর্থিক সক্ষমতার অভাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা নেওয়া এবং অটোমেশন চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে নীতি সহায়তার জন্য বিজিএমইএ কাজ করছে।

তাঁর মতে, সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত হিসেবে পোশাক খাতের সক্ষমতা রয়েছে অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান তৈরিসহ আরও ব্যাপক অবদান রাখার। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শেয়ার মাত্র ৭.৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ সামনে সুযোগ অপরিসীম। বর্তমান সরকার শিল্পবান্ধব সরকার। শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে তৈরি পোশাক খাত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা ও প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্পের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

বিজিএমইএ সভাপতি হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব নেওয়া প্রসঙ্গে এস এম মান্নান কচি বলেন, বিজিএমইএর সঙ্গে তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততা প্রায় ২০ বছর ধরে। গত ১৫ বছরে বিজিএমইএতে বেশ কয়েক মেয়াদে তিনি সহসভাপতি ও সিনিয়র সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে। শ্রমিক ভাইবোনদের কল্যাণ ও শিল্পসম্পর্ক উন্নয়নের জন্যও তিনি কাজ করেছেন। এসব কাজের মূল্যায়ন করে সংগঠনের সদস্যরা তাঁকে আস্থায় নিয়েছেন। তাদের পূর্ণ সমর্থন শিল্পের প্রতি তাঁর দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।


 

আরও পড়ুন

×