ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

‘নেভার লেট মি গো’ যেভাবে

‘নেভার লেট মি গো’ যেভাবে

কাজুও ইশিগুরো [জন্ম : ৮ নভেম্বর ১৯৫৪]

মূল: কাজুও ইশিগুরো ও অনুবাদ: তারেক মিনহাজ

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫ | ০৯:০৬

আমি তখন আমার চতুর্থ ও পঞ্চম উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত। লেখার ঘরটা ছিল এক ঘরোয়া জঙ্গল। চারদিকে ধুলা, হাতের লেখায় ভর্তি কাগজের পাহাড় আর থরহরি দুলে ওঠা ফাইলের স্তম্ভ।

২০০১ সালের বসন্তে আমি নতুন উদ্যমে একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম। এর আগে ঘরটিকে নিজের পছন্দমতো নিলাম সাজিয়ে। ছাদ পর্যন্ত বুকশেলফ, আর দুটি লেখার ডেস্ক, কৌণিক বসানো, ওই আমার মনপছন্দ আর কী। ঘরটা আমার আগের ঘরের চেয়েও ছোট ছিল (আমি সবসময় ছোট ঘরে লেখা পছন্দ করি, জানালার বাইরে তাকানোর সুযোগ আমি চাই না। দৃশ্য পেছনে রাখি), ফলে খুশিই ছিলাম। যারা বলতেন, এই তুমি এতো ছোট ঘরে লেখ কী করে? তাদের বলতাম– পুরোনো ট্রেনের আয়েশী নিদ্রামিতা কামরায় বসে লেখার মজা জানো ভাই? শুধু চেয়ার ঘুরিয়ে হাত বাড়ালেই প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়।

বাম পাশের বুকশেলফে হাতের কাছে রাখা ছিল একটি বক্স ফাইল, লেবেল করা: ‘স্টুডেন্টস্‌ নভেল’। এর ভেতরে ছিল হাতে লেখা নোট, মাকড়ের জালের মতো ডায়াগ্রাম আর কিছু টাইপ করা পাতা–পাতাগুলো দুটি ভিন্ন চেষ্টার ফল। ১৯৯০ ও ১৯৯৫-এ ‘নেভার লেট মি গো’ উপন্যাসটি লেখার চেষ্টা হিসেবে শুরু করেছিলাম। দু’বারই আবার ভিন্ন লেখায় তলিয়ে যাই। নেভার লেট মি গো থেকে যায় ব্রাত্য। 

পাঠক ও লেখক হিসেবে আমি বড় হয়েছি ৭০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যপাঠ আর ৮০-এর দশকের লন্ডনে কথাসাহিত্যের পরিবেশে। সময়টা ছিল সাহিত্যিক উচ্চাভিলাষী যুগ–একটা আন্তর্জাতিক ভাব বজায় ছিল সবলে-প্রবলে, আর উপনিবেশোত্তর সাহিত্যের জন্য হাটখোলা। একই সঙ্গে এই যুগ ছিল জনপ্রিয় ধারার সাহিত্যকে অবজ্ঞা করার সময়। বিশেষ করে সায়েন্স ফিকশন সাহিত্যের প্রতি ছিল এক রহস্যময় অবজ্ঞা। ওটা যেন মূলধারার সাহিত্যই ছিল না। ছিল এর বাইরের রহিম-করিম কেউ। আমি ও আমার সমসাময়িক অনেকে তাই সচেতনভাবে সায়েন্স ফিকশন থেকে দূরে থাকতাম–ভাবতাম, ওটা আমাদের সঙ্গে যায় না। 

৯০-এর দশকের শেষ দিকে আমি হঠাৎ টের পেলাম–এই শর্মা আর ‘তরুণ লেখক’ নেই। ব্রিটেনে তখন এক নতুন, উদ্যমী লেখক প্রজন্ম উঠে আসছে। ওরা আমার থেকে প্রায় দশক দেড়ের ছোট। তাদের কারও কারও লেখা পড়ে দূর থেকেই মুগ্ধ হয়েছি, আবার কেউ কেউ বন্ধু হয়ে উঠেছে। ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আমাকে এক নতুন মঞ্চে নিয়ে এলো। আমার কল্পনার এমন কিছু জানালা খুলে গেল, যেসব খুলবে কখনও ভাবিনি। ওরা আমাকে এক বিস্তৃত, জীবন্ত সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আমার লেখার দিগন্তও দিল বাড়িয়ে।

সেই সময় আরও কিছু বিষয় প্রভাব ফেলতে পারে। ১৯৯৭ সালে ‘ডলি’র ছবিতে সমস্ত সংবাদপত্র সয়লাব। ডলি, অর্থাৎ পৃথিবীর প্রথম ক্লোন করা স্তন্যপায়ী প্রাণী, ভেড়া। বিষয়টি না ভাবিয়ে উপায় কী। ওটা একটি দিক, আবার, আমার আগের দুটি উপন্যাস দ্য আনকনসোল্ড, হোয়েন উই অয়্যার অরফ্যানস লেখার অভিজ্ঞতাও একটু আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল আমাকে। ও দুটো কিন্তু বাস্তব জীবনের বাইরে গিয়ে লেখা। যাই হোক, ‘স্টুডেন্টস নভেল’ লেখার তৃতীয় প্রচেষ্টা আগেরবারগুলোর থেকে আলাদা হলো সন্দেহ নেই। তবে তখনও অনেক সুতো ছিন্ন। মালা গাঁথার ঘটনা ঘটল আরও ক’দিন পর। 

সেদিন, আমি গোসল করছিলাম, আর্কিমিডিসের মতো বাথটাবে নয়, হালের শাওয়ারে, হঠাৎ সেই ‘ইউরেকা’ মুহূর্ত এলো। পুরো গল্পটা চোখের সামনে দেখতে পেলাম! ছবির মতো দৃশ্যপট, সুতোয় সুতোয় গিঁট চক্কর খেতে থাকল মাথায়। তবে তুষ্ট হতে গিয়ে আমি একই ঘটনা তিনটি আলাদা আঙ্গিকে লিখলাম। আমার সহধর্মিণী লরনাকে তা দেখানোর পর সে নির্দ্বিধায় যেটি বেছে নিল, স্বস্তি, সেটি আমার চিন্তার সঙ্গেও মিলে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন

×