
করোনার সংক্রমণ ও প্রকোপ ক্রমেই কমছে। শহর-বন্দর, হাটবাজার, কর্মক্ষেত্র, পর্যটনকেন্দ্র আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে। পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তবে এখনও করোনা-পূর্ববর্তী জীবনধারায় ফিরে যাওয়ার সময় আসেনি। কেননা, এমন স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি গত ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারিতেও ফিরে এসেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরও ভয়ংকর রূপে করোনার আঘাত কেড়ে নিয়েছে কত প্রাণ! কতজনকে করেছে স্বজনহারা! বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সামনে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন। অণুজীব বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলছেন, কয়েক হাজার বছর আগেও এই ভাইরাস পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। কেড়ে নিয়েছিল লক্ষ-কোটি প্রাণ। দূর অতীতের সে কথা না হয় বাদই দিলাম। বিজ্ঞানের জয়জয়কারের এ যুগে করোনা আমাদের অহমিকা ভেঙে দিয়েছে। ক্ষুদ্র একটি অণুজীবের তাণ্ডবে সবার নাভিশ্বাস অবস্থা। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধিতে এক নতুন ও অস্বাভাবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো- প্রাণঘাতী করোনা মোকাবিলায় মানুষের আন্তরিকতা কতটুকু? আমাদের কাজ-কর্মে সতর্কতার বিষয়টি কি প্রকাশ পাচ্ছে? আমরা কি আইনমান্যতাকে ধর্তব্যে আনছি ? নাকি সবকিছু সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেকে নির্ভার রাখছি? মনে রাখতে হবে, সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে চলার সহজ অর্থ হলো নিজেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখা। কভিড ১৯-এর বয়স দুই বছর হতে চলল। তার পরও একে মানিয়ে চলার অভ্যাস আমরা রপ্ত করতে পারিনি। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে অনেকেই নিজেকে, পরিবারকে, সর্বোপরি পুরো সমাজকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। আমরা ভুলে যাই- 'মাস্ক' না পরে, সামাজিক দূরত্ব না মেনে জনারণ্যে ঘোরাফেরা করলে করোনা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। সর্বক্ষেত্রে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে চলা ও নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও ঠিকভাবে এ বিধিবিধান পালিত হয় না। গণপরিবহনে যাত্রীদের গাদাগাদি করে চলাচলের চিত্র তো সচেতন মানুষদের ভাবিয়ে তোলে।
করোনার মধ্যে সামাজিক অনুষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন এলাকা ও বাসাবাড়িতে বসবাসকারী মানুষ একত্রিত হচ্ছেন। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরছেন, হ্যান্ডশেক করছেন; মাস্ক খুলছেন, পাশাপাশি বসে খাচ্ছেন; একজনের শ্বাস-প্রশ্বাস পাশের জনের নাক ছুঁয়ে যাচ্ছে। অনেকেই মনে রাখতে পারেন না, দুঃসময় চলছে এবং তাকে কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হবে। তাই সামাজিক অনুষ্ঠানে আগত অতিথি ও অংশগ্রহণকারীদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য করোনা সতর্কতার বিষয় সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো যেতে পারে এবং সেগুলোর ডিজাইন, ডেকোরেশন ও ক্যালিগ্রাফি এমনভাবে করা যেতে পারে, যেন তা অনুষ্ঠানস্থলের শোভাবর্ধনে ভূমিকা রাখে।
আমরা জানি, অফিস, দোকান, রেস্তোরাঁ, যানবাহন ও হাসপাতাল থেকেই ৯০ শতাংশের বেশি সংক্রমণ হয়ে থাকে। বদ্ধ পরিবেশে বায়ু চলাচল বাইরের তুলনায় কম থাকায় করোনা আক্রান্ত কারও নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিঃসৃত ভাইরাসে ঘরের মধ্যে বা বদ্ধ পরিবেশে অবস্থানরত অন্যরাও আক্রান্ত হয়। ভিন্ন ভিন্ন বাসাবাড়িতে অবস্থান করা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সশরীরে যদি কোনো ধরনের আলোচনা বা সভা করতেই হয়, তবে ঘরের বারান্দা, ছাদ, খোলা জায়গাকে বেছে নেওয়া ভালো। বাসাবাড়ি, দোকানপাট, অফিসে এয়ারকুলারের বদলে পাখা (ফ্যান) ব্যবহার করতে হবে। এসি চালানোর যদি দরকার হয়, তবে অন্তত একটি দরজা বা জানালা খোলা রেখে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে।
জ্বর, সর্দি-কাশি ও করোনার বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে চলৎশক্তি থাকা পর্যন্ত অনেকেই ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। এটা যে অন্যদের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা অনেকেই হয়তো জানি না। এ ব্যাপারে যদি আত্মসচেতনতা না থাকে, তাহলে কীভাবে চলবে? সচেতন মানুষ হিসেবে আমরা যারা নিজেদের উপস্থাপন করি তারাইবা কতটুকু সতর্ক থাকছি? কয়েক দিন আগে পরিচিত একজনের সঙ্গে শ্যামলীতে দেখা। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলা অবস্থায় দেখেছি তিনি আমার কাছাকাছি হচ্ছেন। আমি যতই পিছু হটছি, তিনি আমার দিকে ততই এগিয়ে আসছেন। শেষমেশ সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিষয়টি তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। দু'জন মানুষ সামনাসামনি বসে বা দাঁড়িয়ে কথা বলতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে; দু'জনেরই মাস্ক থাকতে হবে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলতে চান- 'আমাদের এদিকে করোনা নেই। করোনা নিয়ে ভাবিই না, খুব শান্তিতে আছি।' বাস্তবে তাদের আশপাশের অনেকেই করোনায় অসুস্থ হচ্ছে, মৃত্যুও ঘটছে। তারপরও অধিকাংশই এ রোগকে সর্দি-কাশি, জ্বর ব্যতীত অতিরিক্ত কিছু ভাবছেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ অঞ্চলের পরিচালক কয়েক দিন আগে বলেছেন, অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার আগ পর্যন্ত চলমান করোনা মহামারি শেষ হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নেওয়া থাকলে করোনা হলেও মারাত্মক পর্যায়ে যায় না; আক্রান্ত ব্যক্তিকে অন্তত হাসপাতালে যেতে হয় না। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে টিকা নেওয়াতেও শুরুর দিকে অনেকের আগ্রহ ছিল না।
অনেক ভাইরাস বছরের পর বছর পৃথিবীতে টিকে আছে। হয়তো করোনামুক্ত পৃথিবী আর ফিরে আসবে না। তাই এর মধ্যেই করোনা প্রটোকল মেনে জীবনযাপনের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রাণচাঞ্চল্য অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। নিজেকে যেমন বাঁচতে হবে, অন্যকেও বাঁচাতে হবে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিপরীতে একই সঙ্গে পরস্পরের মধ্যে আত্মিক দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে।
উপপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর
snagari2012@gmail.com
মন্তব্য করুন