প্রবাসের কর্মস্থল থেকে দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের ৬০ শতাংশই এখন বেকার- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ তথা বিলস পরিচালিত এক জরিপে উঠে আসা এই তথ্য আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। আরও উদ্বেগের বিষয়, এসব নারী শ্রমিকের ৬১ শতাংশের মাথায়ই গড়ে ৭৭ হাজার টাকার ঋণের বোঝা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের পাশে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। বস্তুত বিলসের জরিপে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা নিছক বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের বিষয় হতে পারে না। এতে দেখা যাচ্ছে, নারী শ্রমিকদের ৫৫ শতাংশকেই জোর করে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যাশিত কাজ ও মজুরি না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন ২৩ শতাংশ। আমরা জানি, এসব নারীর প্রায় সবাই বৈধপথে বিদেশে গিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে তারা কর্মাদেশের মাধ্যমেই নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাহলে তাদের এভাবে জোর করে ফেরত পাঠানো বা নির্ধারিত মজুরি ও কর্ম থেকে বঞ্চিত করা হবে কেন? তাদের অধিকার ও দাবি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্নিষ্ট দূতাবাসগুলোকে এখনই সক্রিয় হতে হবে। আমরা জানি, মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া আমাদের নারী শ্রমিকরা নানা প্রতারণা এবং শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তাদের বেশিরভাগই যে কাজের জন্য প্রবাসে পাড়ি জামান, অধিকাংশই সেই কাজে নিযুক্ত হতে পারে না। বরং অমর্যাদাকর অনেক কাজে জোর করে নিয়োজিত করা হয়। আবার যে পারিশ্রমিক পাওয়ার কথা, তাও মেলে না। সবচেয়ে উদ্বেগ ও বেদনাদায়ক তাদের ওপর নির্বিচার যৌন নির্যাতন। স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পরিবার-পরিজন ফেলে পরদেশে গিয়ে দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে অনেকে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। বিলসের জরিপেও তা উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের ৫২ শতাংশ জবরদস্তিমূলক শ্রমের শিকার। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৭ শতাংশ। ৩৮ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব নারী শ্রমিকের ৫৫ শতাংশই শারীরিকভাবে এবং ২৯ শতাংশ মানসিকভাবে অসুস্থ। যদিও তাদের ৮৭ শতাংশই কোনো চিকিৎসা পাননি। এমন পরিস্থিতিতে প্রবাসে তাদের অধিকার ও নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশে যাতে উপযুক্ত চিকিৎসা পান, সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় প্রবাসফেরত নারী শ্রমিকদের জীবন সহজ নয়। বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানোর সময় পরিবারে যতটুকু সম্মান ও মর্যাদা পায়, ফিরে আসার পর তাও আর থাকে না। এসব নারী যাতে পরিবার ও সমাজের কাছে 'বোঝা' না হন, তা দেখতে হবে সরকারকেই। এক্ষেত্রে সামাজিক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। ভুলে যাওয়া চলবে না, তারা যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত, তেমনই অমানবিক পরিস্থিতির শিকার। এই পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। এও মনে রাখতে হবে, এভাবে দলে দলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রবাসী শ্রমিক মেয়াদপূর্তির আগেই ফিরে আসতে থাকলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে। পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রেও দেখা দেবে অস্থিরতা। তাদের অনেকেই শেষ সম্বলটুকু বাজি ধরে বিদেশে গেছেন। অনেকে চাকরি বা ব্যবসা ছেড়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের পক্ষে নতুন করে জীবিকার অন্বেষণ সহজ হবে না। বড় কথা, এভাবে অধিকার ও সম্বলহীন হয়ে ফিরে আসবে কেন? এই নারীদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় পুনর্বাসনসহ দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার যে সুপারিশ বিলসের পক্ষে করা হয়েছে, তা যথার্থ। একই সঙ্গে প্রবাসে এবং দেশে ফেরার পর নারী শ্রমিকের বঞ্চনা নিয়েও ভাবতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে যখন নারীর দৃপ্ত পদচারণা, তখন জনশক্তি খাতে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে গিয়ে তাদের এভাবে নিপীড়নের শিকার হতে দিতে পারি না। সরকারি ও বেসকারি পর্যায়ে সবাই যদি পাশে দাঁড়াই, তাহলে আমাদের নারী শ্রমিকরাও মাথা উঁচু করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চলতে পারবেন।

বিষয় : প্রবাসফেরত নারী শ্রমিক

মন্তব্য করুন