
অনন্ত বালা দাশ। রক্তি নদীর ধারে বাড়ি ছিল তার। সামনে নীলকণ্ঠ ফুলের মতো টকটকা মেঘালয় পাহাড়। প্রতিবার খাওয়ার আগে তিনি মাটিতে এক লোকমা ভাত-শাক ছড়িয়ে দিতেন। পিতলের ঘটি থেকে ছিটিয়ে দিতেন জল। রামায়ণ পাঠের আসর থেকে ফেরার সময় দেখেছি, পথের বিড়াল-কুকুরছানাদের জন্য পুুঁটলি থেকে এক মুঠ খাবার রেখে যেতেন 'সযতনে'। 'সযতনে' বিশেষণটি আমার শৈশবের উপলব্ধি নয়; এখন এই বয়সে মনে হয়েছে। কাক-চড়ূইদের ভাত না ছিটিয়ে তিনি অন্ন গ্রহণ করতেন না। নিজের স্নান সেরে প্রথমেই তুলসী গাছকে স্নান করাতেন। আর তার ছিল এক বিস্ময়কর ছোট্ট বাগান। রাজ্যের মানুষ এই লতা, সেই পাতা, ওই শিকড় নিতে ভিড় জমাত। তাকে জিজ্ঞেস করতাম, এমন কেন করো, ঠাকুমা? বাতাসে পান-সুপারির ঘ্রাণ ছড়িয়ে বলতেন, 'জগৎ জননীর কাছে বাঁচবার ঋণ শোধ করিরে।' অনন্ত বালা দাশের সেই জটিল উত্তর আমি শৈশবে বুঝতে পারিনি। এখনও এর মর্ম ধারণ করতে পারিনি। জগৎ জননীর কাছে ঋণ! কী আমাদের ঋণ এই জগৎ জননীর কাছে? আজ যখন পরিবেশ, প্রতিবেশ, রাজনীতি কিংবা জলবায়ু সংকট নিয়ে তুমুল তর্ক উঠছে, তখন আমার একজন অনন্ত বালা দাশের কথা মনে পড়ে। তার জীবনযাপন, দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা পৃথিবীর প্রতি দায়িত্ববোধ আজ বিস্ময় জাগায়।
করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত দুনিয়ায় একটা আলাপ জনপরিসরে বেশ আলোচিত- পৃথিবীর মানুষ পরিবেশ প্রশ্নে বেশ সতর্ক হয়েছে। প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে। কিন্তু প্রকৃতির প্রতি মানুষের অবিচার-অত্যাচারের পরিসংখ্যান সেটি প্রমাণ করে না। মহামারির ভেতরেও মানুষ শামুকখোল পাখি খুন করেছে, হাতি হত্যা করেছে, মাটি বিষাক্ত করেছে, নদী দখল করেছে কিংবা অরণ্য লুট করেছে। মানুষ হিসেবে আমরা এখনও এই গ্রহের কাছে আমাদের বেঁচে থাকার ঋণ স্বীকার করিনি। পৃথিবীর কাছে ঋণ স্বীকারের সংস্কৃতি, শিক্ষা ও নীতি চালু করিনি। সৌরজগতের এই ছোট্ট নীল গ্রহে মানুষ নামক এক প্রজাতি হিসেবে আমরা বেঁচে আছি পুরোপুরি আর সব প্রাণ-প্রজাতির ওপর নির্ভর করেই। প্রকৃতির বিপুল বৈচিত্র্য আর বাস্তুসংস্থানের বিস্ময়কর সহযোগিতাই আমাদের প্রতিদিন বাঁচিয়ে রাখছে। সম্পূূর্ণ পরনির্ভরশীল এক প্রজাতি হিসেবে আমরা কি প্রাণ-প্রকৃতির এই অবদান স্মরণ করছি?
গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয় বলে আমরা দম নিতে পারি। বৃক্ষ-মাছ-পাখি খাবার দেয় বলেই আমরা খেতে পারি। ভূমণ্ডলে পানি আছে বলেই আমরা পান করতে পারি। এই মাটি-জল-হাওয়া আছে বলেই আমরা গান গাই, ছবি আঁকি, কাঠামো গড়ি। একটি গাছ নিজের খাদ্য তৈরি করতে পারে। একটি মাছ বা বনরুই বা মৌমাছি নিজের বেঁচে থাকার জন্য অন্যের সংসার তছনছ করে না। পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের ব্যাকরণ উল্টেপাল্টে দেয় না। প্রকৃতির ওপর দখল, দূষণ কিংবা লুটতরাজ একমাত্র মানুষই করে। মানুষই মাটির তলার জল মেশিন দিয়ে টেনে তুলে মাটির বুক নিঃস্ব করে। চীনামাটির বাসনের জন্য পাহাড়ের পর পাহাড় কেটে নিশ্চিহ্ন করে। জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য পৃথিবীর কলিজা, ফুসফুস ছিন্নভিন্ন করে। ভোগ আর বিলাসিতা শব্দগুলো কেবল মানুষের সমাজেই আছে। কিন্তু এভাবে নিশ্চয়ই বহুকাল চলতে পারে না। জীর্ণ, নিঃস্ব এক গ্রহ আর কতকাল এভাবে কেবল প্রজাতি হিসেবে মানুষের অনাচার সইবে? মানুষের দশাসই কার্বন দূষণে পৃথিবী আজ মুমূর্ষু।
কিন্তু এখনও উত্তর-দক্ষিণ বিবাদ, কাঠামোগত বৈষম্য আর নিদারুণ দ্বন্দ্ব থামছে না। চীন, মার্কিন, রাশিয়া কি ভারত- কে হবে অধিপতি; এই দরবার প্রতি মুহূর্তে বিদীর্ণ করছে পৃথিবীর শরীর। রক্তাক্ত করছে ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক বিবর্তন। সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া বেঁচে থাকার জন্য আর কোনো গ্রহ আছে কিনা, এখনও আমাদের জানা নেই। আমাদের সব ইতিহাস, নীতি, বিশ্বাস, উৎপাদন ও সংস্কৃতি- এই একমাত্র ছোট্ট নীল গ্রহকে ঘিরেই। প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকার স্বার্থেই আমাদের প্রিয় এই গ্রহকে আগলে দাঁড়ানো জরুরি। নিজের দায়দায়িত্ব প্রমাণ করে; সবার সঙ্গে, একসঙ্গে, জোরালো ভঙ্গিতে, দুর্নিবার। সব মেকি কান্না, লোক দেখানো দরদ কিংবা মাস্তানি পরিহার করে সাহস নিয়ে সত্যিকারভাবেই দাঁড়ানোর মতো দাঁড়াতে হবে। এই গ্রহ কারও কাছে জগৎ জননী, কারও কাছে মাতৃদুনিয়া। তো একজন ব্যক্তি হিসেবে এই গ্রহের জন্য আমরা কী বিনিয়োগ করেছি? কী ধরনের এবং কী কায়দার বিনিয়োগ করেছি বা করছি- আজ এই প্রশ্ন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, ভূগোল, বাজার সব প্রান্ত থেকেই ওঠা জরুরি। পৃথিবীর টিকে থাকার প্রশ্নে আসুন আমরা আমাদের বিনিয়োগগুলো শামিল করি; একত্র করি। সযতনে। শৈশবে বুঝতে না পারলেও আজ উপলব্ধি করছি- এই 'সযতনে' কতটা জটিল, কতটা গভীর আর কতটা দায়িত্ববোধের কাজ।
প্রতি বছর ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস পালিত হয়। ২০২২ সালের ধরিত্রী দিবসের প্রতিপাদ্য- 'আমাদের গ্রহের জন্য বিনিয়োগ করুন'।
আজ আমাদের প্রিয় গ্রহ এক নিদারুণ সংকটের খাদে দাঁড়িয়ে। এই সংকট আমরাই তৈরি করেছি। তাই আমাদের প্রিয় গ্রহকে বাঁচাতে মানুষ হিসেবে আমাদেরই দায়িত্বশীল হতে হবে। গ্রহের সুরক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতির স্বাস্থ্য ও খাদ্যশৃঙ্খল সুরক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ দরকার। পাহাড়, অরণ্য, নদী, হাওর, ঝিরি-ছড়া, বাঁওড়-বিল, বরেন্দ্র-গড়, সমুদ্র বা দ্বীপের অস্তিত্ব ও প্রাকৃতিক বিকাশের জন্য বিনিয়োগ দরকার। আমরা ভবিষ্যতের জন্য ভাবছি। আর এই ভবিষ্যৎ শুধু মানুষের জন্য নয়। একটি নদীর ভবিষ্যতের কথা আমাদের ভাবতে হবে। নদীর মাছ, শামুক, ডলফিন, ঘড়িয়াল, অণুজীব, কাঁকড়া সবার পরিবারের কথা ভাবতে হবে।
আজ একটি পরিবেশ উপযোগী চারা বা বীজ বপনের ভেতর দিয়েও আমাদের একটি ছোট্ট বিনিয়োগ শুরু হতে পারে। আজ যদি আমরা কয়েক ঘণ্টা এসি ছাড়া, ফ্রিজ ছাড়া, প্রাইভেট গাড়িতে না চড়ে থাকতে পারি; তবে এটিও এই গ্রহের জন্যই আমাদের বিনিয়োগ হতে পারে। নদীতে আমরা কোনো প্লাস্টিক ফেলব; রাসায়নিকমুক্ত খাদ্য উৎপাদন করব- এ রকম অঙ্গীকার আমাদের বিনিয়োগকে শক্তিশালী করবে। পৃথিবীব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন, ব্যবহার ও বিপণন যেদিন বন্ধ হবে, সেদিন হয়তো এই গ্রহ কিছুটা প্রাণ ফিরে পাবে। আর এ কাজটি একমাত্র সম্ভব আমাদের জীবনাচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভ্যাস পাল্টানোর ভেতর দিয়ে। আর এই প্রিয় গ্রহের জন্য এটি হতে পারে আমাদের এক বিপুল বিনিয়োগ। আসুন, আমরা শুরু করি কাজ এখন থেকেই।
পাভেল পার্থ: প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক
animistbangla@gmail.com
মন্তব্য করুন