
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। ঢাকার মেট্রোরেল, হাতিরঝিল প্রকল্পসহ উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক এবং কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের পরিকল্পনাকারীও তিনি। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ থেকে বিএসসি ও এমএসসি অর্জনকারী শামসুল হক পিএইচডি করেছেন ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটন থেকে।
সমকাল: জাতিসংঘ ঘোষিত সড়কের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো আমাদের দেশের জন্য কতটা প্রযোজ্য?
ড. এম শামসুল হক: ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ঘোষণা অনুযায়ী জাতিসংঘ ওই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো বিশ্বের সব দেশের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য করে দিয়েছে। এটার অর্থ এই নয়, এর বাইরে আর কোনো উদ্যোগ থাকবে না; যেমন- আমাদের দেশে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো বাইরের দেশের মতো নয়। সে হিসেবে তাদের সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া ফ্যাক্টরগুলো যেমন অর্জন করতে হবে; পাশাপাশি আমাদের দেশের বাস্তবতায় আরও যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়েও কাজ করতে হবে।
সমকাল: আমাদের দেশের সমস্যাগুলো কেমন?
ড. এম শামসুল হক: এখানে যাঁরা নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আছেন, কেউই কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বা আধুনিক গণপরিবহনের লোক নন। ফলে তাঁরা সাধারণ বুদ্ধিতে বা বিভিন্ন চাপে এলোমেলো সিদ্ধান্ত নেন। পেশাদার না হওয়ায় গণপরিবহনের মূল সমস্যা না বুঝে উপসর্গ দেখে পদক্ষেপ নেন। সমাধানের জন্য বিজ্ঞান কী বলছেন, সেদিকে মনোযোগ দেন না। লাফ দিয়ে চলে যান আইন প্রয়োগে। অথচ সিস্টেম ও প্ল্যান সঠিক হলেই তো হয়ে যায় অনেক কাজ। ভুল প্ল্যানে আইন প্রয়োগে টেকসই ফল আসবে না।
সমকাল: এ খাতে বরাদ্দ তো অনেক। সরকার কেন কাজ আদায় করতে পারছে না?
ড. এম শামসুল হক: সড়ক নিরাপত্তায় যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের কাজের জবাবদিহি নেই। দায়িত্বে অবহেলার জন্য কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না। তাই সরকার যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ করে এবং জনবল দিয়েও কাজ আদায় করতে পারছে না। তার মানে, সুশাসনের অভাব। এ জন্য নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চালকরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাবেন না- সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেওয়া এ নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয়নি। এ রকম অনেক নির্দেশনা উপেক্ষিত।
সমকাল: এখানে সিট বেল্ট সম্পর্কিত ঝুঁকিটা কেমন?
ড. এম শামসুল হক: চালক-যাত্রীর সুরক্ষার জন্য সিট বেল্ট জরুরি। তবে আমাদের দেশে সিট বেল্ট পরলেও দুর্ঘটনাজনতি মৃত্যু কমানো যাবে না। এর কারণ হলো, চেসিসটা এনে সিটগুলো নিজের মতো বসানো হয়। দেওয়ার কথা লাইন ঝালাই; দেওয়া হয় স্পট ঝালাই। যেনতেন ঝালাই দিয়ে সিটকে মেঝের সঙ্গে লাগানো হয়। দুর্ঘটনার সময় প্রতিটা চেয়ার যাত্রীসহ ফ্লোর থেকে খুলে পড়ায় একজনের নিচে আরেকজন চাপা পড়ে। দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের একটা দুর্ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছি, দুটিতে যাত্রী ছিল সমান। কিন্তু একটাতে ১৬ জন, অপরটাতে দু'জন মারা গেছে। ১৬ জন কোন বাসে মারা গেছে? যে বাসে স্পট ওয়েল্ডিং ঝালাই ছিল। মুখোমুখি সংঘর্ষে সব সিট খুলে পড়ায় একজনের ওপর আরেকজন পড়ে গেছে। অন্য বাসের সিটগুলোর কিছু হয়নি।
সমকাল: দুর্ঘটনার বড় কারণ বেপরোয়া গতি। এটি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায় কী?
ড. এম শামসুল হক: সারাবিশ্ব বিজ্ঞানভিত্তিক স্বনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে একটা করিডোর করে একটা অপারেটরকে গণপরিবহন পরিচালনা করতে দেওয়া হলে দেখবেন, ওই কোম্পানির আওতায় ৫০০ বাস নিয়ে বিনিয়োগে আসবেন মালিকরা। মালিককে যদি বলেন, তোমার ড্রাইভার ওভার হাইস্পিডে চললে রুট পারমিট বাতিল হয়ে যাবে; মালিকের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। কেন? কারণ বিনিয়োগটা অনেক বড়। আমাদের এখানে ছাগলের পাল ছেড়ে দিয়ে তাদের পেছনে ছোটে। তারপর বলে, আমরা তো পারি না। পুলিশ বলে, পারি না। বিআরটিএ বলে, পারি না। আমলারা বলে, আমি কতবার ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়েছি। আসলে শুরুটাই তো হয়েছে ভুল দিয়ে। অপারেটর সিস্টেম চালু করুন। এর পর অনিয়ম করলে শুধু একটা ই-মেইলে সতর্ক করে দিয়ে বলুন- পরবর্তী সময়ে আইন না মানলে রুট পারমিট বাতিল হয়ে যাবে। দেখবেন, ঠিক হয়ে যাবে।
সমকাল: চালকদের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রবণতা এত বেশি কেন?
ড. এম শামসুল হক: আমাদের দেশে চালকরা বিভিন্ন কারণে হতাশাগ্রস্ত। বেতনভুক্ত না হওয়ায় মালিকের সঙ্গে দরকষাকষিতেও দুর্বল। তাঁর ঝুঁকিটা মালিককে বলারও সাহস পান না। বলতে পারেন না, টায়ারটা যে কোনো সময় ফেটে যেতে পারে। কারণ মালিক বলবেন- তুমি না চালালে আরেকজনকে দিয়ে চালাব। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালান। গাড়ির ত্রুটিজনিত দুর্ঘটনা ঘটলেও মালিকের কিছু হচ্ছে না। সব দোষ চালককে দেওয়া হয়। চালক দেখছেন, সোশ্যাল অ্যান্ড লিগাল, সব ঝুঁকি তাঁকে নিতে হচ্ছে দুর্ঘটনার পর। আবার অতিরিক্ত সময়ে বিরতিহীনভাবে গাড়ি চালাতে হয়। অবসাদ ও ক্লান্তি কাটাতে তাঁরা মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। একজন চালককে ঘুমের সময়ও যখন ড্রাইভিং করতে হয় তখন মস্তিস্কে একটি আর্টিফিসিয়াল এনভায়রনমেন্ট তৈরির চাহিদা বেড়ে যায়। এটাকে এক্সট্যাসি বলে। মানে ড্রাগের মাধ্যমে আর্টিফিসিয়াল একটা উদ্দীপনা তৈরি করা। এভাবে গাড়ি চালাতে চালাতে এক সময় মাদকে আসক্ত হয়ে যান।
সমকাল: এর সমাধান কী?
ড. এম শামসুল হক: ড্রাগের সমস্যা কিন্তু চালকের অনেক ধরনের আর্থসামাজিক ও পেশাগত। সরকারের এখানে অনেক করণীয়। নিরাপদ সড়কের জন্য সমন্বিত একটি কার্যকর কৌশল প্রণয়নে সংশ্নিষ্ট সবার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা দরকার। তা না হলে চালকরা সোশ্যাল ক্রসফায়ারে পড়তেই থাকবেন, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলো কখনও দূর হবে না।
সমকাল: তার মানে, সব দিক থেকে দায় চলে যায় চালকের ওপর? অন্য ঝুঁকিগুলোয় নজর কম?
ড. এম শামসুল হক: আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কেন হয়, তার একটি মাত্র উপসর্গের দিকেই আমরা সাধারণত নজর দিয়ে থাকি। সেটি হলো, দুর্ঘটনার সব দায় শুধু গাড়িচালকের। পেশাগত জায়গা থেকে আমি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করছি। এটি করতে গিয়ে দেখেছি দুর্ঘটনার বাকি যেসব নিয়ামক, তার বেশিরভাগই বিবেচনার বাইরে থেকে যায়। সব দায় গিয়ে পড়ে চালকের ওপর।
সমকাল: সড়ককে নিরাপদ করতে হলে আমাদের কোন পথে এগোতে হবে?
ড. এম শামসুল হক: টেকসইভাবে যদি কিছু অর্জন করতে চাই তাহলে বিজ্ঞানভিত্তিক পথে যেতে হবে। যেগুলো অর্জনযোগ্য, যেভাবে অন্য দেশ সফল হয়েছে, তাদের পথটাকে আমাদের মতো করে অনুসরণ করতে হবে। তাহলে দেখব- এখানে শুধু পরিশ্রম, পরিশ্রম আর পরিশ্রম। আমরা পরিশ্রমটা কমিয়ে অভিযানসর্বস্ব হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ কিছু ম্যাজিস্ট্রেসি অভিযান, চোর-পুলিশের মতো খেলা হয়। তারপর একই রকম। আমাদের সমস্যাটা সেই জায়গায়। আমরা ভুল পথে আছি। সমস্যা তৈরি করে পরিকল্পনা করি। তারপর ম্যানেজ করতে যাই। আসলে সঠিক পরিকল্পনার জন্য কোনো বিনিয়োগ লাগে না। শুধু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শুধু কিছু স্মার্ট পরীক্ষিত থিংকিং; যেটা কার্যকর সেটা প্রয়োগ করতে হবে। টেকসইভাবে কাজ করতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়েতে পরিকল্পনা করতে হবে। এর পর লক্ষ্য অর্জনে দরকার হবে এডুকেশন অ্যান্ড এনফোর্সমেন্টের। এখন যেসব ভুল হচ্ছে এবং সেই ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যানিংয়ে যা করার কথা, তা যদি করি তাহলে আর সমস্যা সৃষ্টি হবে না।
মন্তব্য করুন