
এমপি মানে মেম্বার অব পার্লামেন্ট; বাংলায় সংসদ সদস্য, যাঁর মূল কাজ আইন প্রণয়ন করা। সুতরাং আইনকানুন বোঝেন বা বোঝার মতো জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান আছে, এমন ব্যক্তিরাই এমপি হবেন- এটিই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এমপি হওয়ার জন্য তাঁর আইনকানুন বোঝা তো দূরে থাক, নূ্যনতম পড়ালেখা জানাও শর্ত নয়। বয়সের সীমারেখা থাকলেও শিক্ষাদীক্ষা একজন নাগরিকের সংসদ সদস্য হওয়ার পথে কোনো বাধা নয়, শর্ত নয়। সে ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বহুদিন ধরেই একাডেমিক পরিসরে আছে সেটি হলো, পড়ালেখা না জানা মানুষ যখন আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার ভেতরে ঢুকে যান; বিশেষ করে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রী আইনের খসড়া (বিল) সংসদে উত্থাপনের পরে স্পিকার যখন সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠান, সেখানে ওই এমপিরা কী ভূমিকা পালন করেন? ওই বিলের ওপরে কমিটির প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপনের পর বিলের ওপরে যে আলোচনা হয় সেখানেই বা তাঁরা কী ভূমিকা রাখতে পারেন? তাঁদের কাজ কি শুধু 'হ্যাঁ' অথবা 'না' বলা?
এটা ঠিক যে, এমপি হওয়ার পর তাঁদের বিভিন্ন ধরনের ওরিয়েন্টেশন হয়। কিন্তু সেসব ওরিয়েন্টেশনের মধ্য দিয়ে একজন এমপি সংবিধান, আইনকানুন, এমনকি সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি (সংসদ পরিচালনার লিখিত নিয়ম) সম্পর্কেই বা কতটুকু জ্ঞান অর্জন করতে পারেন? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এমপিদের ভূমিকা আসলে কতটুকু?
২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি সমকালের একটি রিপোর্টে বলা হয়, নবম সংসদের মতো দশম সংসদও বিল পাসে সবচেয়ে কম সময় ব্যয় করছে। বিল পাসের প্রক্রিয়ায় ঘুরেফিরে সর্বোচ্চ ১০ জন এমপিকে অংশ নিতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন জাতীয় পার্টির সদস্য ফখরুল ইমাম। তিনি বলেন, মন্ত্রীদের সময়ের বড় অভাব। তাঁরা সংসদে যে বিলটি উত্থাপন করেন, তাও ভালোভাবে পড়ে দেখেন না। বিলের ওপর প্রশ্ন করা হলে তাঁরা অন্য প্রসঙ্গে জবাব দেন। সংশোধনী প্রত্যাখ্যান করলেও তার কারণ বলেন না।
দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন টিআইবির গবেষণাও বলছে, জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত আলোচনাতেই সবচেয়ে কম সংখ্যক সংসদ সদস্য অংশ নেন। ২০১৯ সালের আগস্টে প্রকাশিত টিআইবির একটি গবেষণায় বলা হয়, দশম সংসদের ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে আইন প্রণয়ন (বাজেট ব্যতীত) আলোচনায় অংশ নিয়েছেন মাত্র ৯৪ জন। ওই সংসদের ২৩টি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে মোট প্রায় ১৬৮ ঘণ্টা ১২ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে, যা অধিবেশনগুলোর ব্যয় হওয়া মোট সময়ের মাত্র ১২ শতাংশ।
কারা এমপি হতে পারবেন ও পারবেন না- এ সম্পর্কিত সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য হবেন। তবে যদি আদালত তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন; তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি লাভ না করেন; তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কমপক্ষে দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁর মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়; ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে থাকেন; তিনি যদি প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তাহলে সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। অর্থাৎ এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো বিধান বা শর্তই নেই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তখন সংবিধান প্রণেতারা এমপি হওয়ার শর্তের মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি কেন রাখেননি, সেটি বোঝা যায়। কারণ তখন দেশে শিক্ষার হার ছিল যথেষ্ট কম এবং ওই সময়ে যাঁরা রাজনীতি করতেন, যাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতেন। সেখানে তাঁদের ব্যক্তি ইমেজ, মানুষের জন্য কাজ করা, তাঁদের বিপদ-আপদে পাশে থাকা, সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত থাকা; সর্বোপরি পারিবারিক পরিচিতিই ছিল মুখ্য। কিন্তু গত অর্ধশতকে দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। প্রান্তিক অবস্থানের অনেকে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিচ্ছেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং এমপি হওয়ার মতো শিক্ষিত লোক পাওয়া যাচ্ছে না- এমন কথা এখন আর বলার সুযোগ নেই। বরং শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম কেন রাজনীতিতে আসছে না; আসতে পারছে না- সেটি বিরাট তর্ক। সেখানে রাষ্ট্রের সামগ্রিক সিস্টেম এবং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বড় কারণ বলে মনে করা হয়। আবার এই সিস্টেম পরিবর্তন তথা দুর্বৃত্তায়ন কমাতে শিক্ষিত মানুষকেই যে রাজনীতিতে আসতে হবে; আইনপ্রণেতার ভূমিকা পালন করতে হবে, সেটিও বাস্তবতা এবং শিক্ষিত মানুষকে সংসদে নিয়ে আসার প্রথম শর্তই হতে পারে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের সংশোধন। অর্থাৎ এমপি হওয়ার জন্য একটি নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত জুড়ে দেওয়া উচিত।
যদিও এ পর্যন্ত যতবার সংবিধান সংশোধন হয়েছে, এর কোনোবারই এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এমনকি ২০১১ সালে যখন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অনেকখানি পরিবর্তন করা হলো, তখনই বিষয়টি যুক্ত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটি সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি বিবেচনায় নেয়নি। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে, সংসদ সদস্যরাই এই বিধান যুক্ত করার বিরোধিতা করতেন। কারণ ওই সংসদেও এমন অনেক এমপি ছিলেন, যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা একজন আইনপ্রণেতা হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না; এখনও যে প্রায় সাড়ে তিনশ এমপি (সংরক্ষিত আসনসহ) আছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন আইনপ্রণেতা হওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানসম্পন্ন- তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
এর পরও পরিবর্তনের সূচনা এখনই করা দরকার। সংসদের আগামী অধিবেশনেই যে সংবিধান সংশোধন করে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বা করা যাবে, সেটি হয়তো নয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে একাডেমিক পরিসরে তো বটেই, রাজনীতিবিদদের মধ্যে, এমনকি সংসদেও আলোচনার সূত্রপাত হওয়া দরকার।
দেশ যেহেতু নানা খাতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং দিনশেষে রাজনীতিবিদরাই যেহেতু দেশ পরিচালনার মূল দায়িত্বটি পালন করেন; বিশেষ করে আইন প্রণয়নের মতো একটি সিরিয়াস ও সূক্ষ্ণ কাজ যেহেতু পড়াশোনা না জানা মানুষের পক্ষে সত্যিই কঠিন, সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় না হলেও অন্তত সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার একটি শর্ত সংবিধানে থাকা উচিত বলে মনে হয়।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
মন্তব্য করুন